23.5.11


পবিত্র ঈদুল আজহা
আত্মত্যাগের এক বিরল দৃষ্টামত্ম
শাহ আলম বাদশা

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ন্যায় মুসলিম জাতির জন্যও রয়েছে দুটো আনন্দ উৎসবের দিন। এর একটি পবিত্র ঈদুল ফিতর আর অন্যটি হলো- ঈদুল আজহা। তবে মুসলমানদের ঈদোৎসব নিছক ভোগলিপ্সা এবং উদ্দেশ্যহীন কোনো আনন্দ-স্ফূর্তির নাম নয়। এর পেছনে রয়েছে সুদুরপ্রসারী মহান আত্মত্যাগ এবং একজন আরেকজনকে ভ্রতৃত্ববন্ধনে আপন করে নেয়ার অনুপম এক শিক্ষা। ঈদুল আজহার আসল শিক্ষা হচ্ছে- একাধারে মহান আলস্নাহর কাছে শর্তহীন আনুগত্যপ্রকাশের মাধ্যমে তারই সমেত্মাষ্টিবিধান, সুদুর মক্কায় গিয়ে পবিত্র কাবাশরীফ তাওয়াফের পাশাপাশি মনের পশুকে হত্যার উদ্দেশ্যে পশুকোরবানীর দ্বারা আলস্নাহতে আত্মোৎসর্গ করা এবং ভাষা, জাতি, বর্ণনির্বিশেষে বিশ্বমুসলিমের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা। কুরবনীর আভিধানিক অর্থ হলো- নৈকট্যলাভের মাধ্যম এবং পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে- ঈদুল আজহার দিন আলস্নাহর সমেত্মাষ্টি ও নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে আর্থিক কোরবানী তথা পশুকোরবানীর মাধ্যমে আত্মত্যাগ। রসুল (সাঃ) বলেছেন- এটা তোমাদের আদিপিতা হজরত ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নত।

যদিও ইবরাহীম আঃ স্বপ্নযোগে নিজ শিশুপুত্র ইসমাইল আঃ কে কোরবানী করতে দেখেছিলেন; ফলে একে আলস্নাহর নির্দেশ মেনে তিনি তা আবার বাসত্মবেও রূপদান করতে গিয়েছিলেন। তাই আলস্নাহ তার এবং তার শিশুপুত্রের আত্মত্যাগ ও আনুগত্য দেখে সন্তুষ্টচিত্তে তার কোরবানী কবুল করে নিয়েছিলেন। অতপর আলস্নাহ কিয়ামত পর্যমত্ম মুসলিম জাতির জন্য নিজ সমত্মানের বদলে পশুকোরবানীই ফরজ করে দিয়েছেন।  এ ব্যাপারে আলস্নাহ বলেন- ‘‘ইবরাহীম আঃ বললো, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে এক সৎপুত্র দান করো। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অুপর যখন সে পিতার সাথে চলাচলের বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবহীম তাকে বললো, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এখন তোমার কী অভিমত বলো? সে বললো, পিতা আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা-ই করম্নন। আলস্নাহ চাইলে আপনি আমাকে সবরকারীদের মধ্যে পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্যপ্রকাশ করলো এবং  ইবরাহীম আঃ তাকে যবেহ করার জন্য শায়িত করলো তখন আমি তাকে ডেকে বলস্নাম-- হে ইবহীম, তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত কওে দেখালে। আমি এভাবে সৎকর্মশীলদেও প্রতিদান প্রদান করি। নিশ্চয়ই এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্য মহান এক জন্তু (সুরা সাফফাত)।’’

কোরবানীর গুরম্নত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে কোরআন এবং হাদীসে বহু নির্দেশ রয়েছে। যেমন-‘‘কোরবানীর জন্তুকে আমি তোমাদের জন্য নিদর্শন করেছি। এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের কল্যাণ (সুরা হজ্জ)। নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু বিশ্বজগতের প্রতিপালক আলস্নাহতায়ালার জন্য (সুরা আনআম)। আলস্নাহর নিকট তোমাদের কোরবানীর গোসত্ম বা রক্ত কিছুই পৌঁছে না, পেছছে শুধু তোমাদের আলস্নাহভীতি।’’ কোরবানী একটি আর্থিক ইবাদত যা কতিপয় শর্তেই শুধুমাত্র একজনের ওপর ওয়াজিব হয়, অন্যথায় নয়। যেমন- মুসলিম হওয়া, সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়া, মুকিম হওয়া বা মুসাফির না হওয়া, নেসাব পরিমাণ মাল-সম্পদ থাকা এবং কোরবানীর দিন সশরীরে উপস্থিত থাকা। কোরবানীর নেসাব সম্পর্কে অনেকের মধ্যে বিভ্রামিত্ম থাকা স্বাভাবিক। মূলত: ঈদুল আজহার দিনগুলোর কোনো একদিন কোনো মুসলমানের নিকট নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদে সাড়ে সাত তোলা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার ওপর পশুকোরবানী ওয়াজিব। আর কোরবানী হতে হবে শুধুমাত্র আলস্নাহর জন্যই অন্য কারো নামে নয়। অন্য কারো নামে কোরবানী করা হলে তা হবে হারাম। আইতো আলস্নাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন যে, ‘‘বলো  নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু বিশ্বজগতের প্রতিপালক আলস্নাহতায়ালার জন্য (সুরা আনআম)।


কোরবানী যেহেতু আলস্নাহর সমেত্মাষ্টিবিধানের জন্যই করা হয় সেহেতু কোরবানীর পশু হতে হবে নিখুঁত ও সুস্থ-সবল। আর মাত্র ছয়শ্রেণীর পশুদ্বারা কোরবানী করা বৈধ। যেমন- উট, গরম্ন, মহিষ, ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া।। কোরবানীর পশুর বয়সেরও একটা বাধ্যবাধকতা আছে। উটের বয়স অমত্মত পাঁচবছর, গরম্ন ও মহিষের বয়স দু‘বছর এবং ভেড়া ও ছাগলের বয়স অমত্মত এশবছর পূর্ণ হতে হবে নতুবা কোরবানী বৈধ হবেনা। অবশ্য ছাগল বা ভেড়ার ক্ষেত্রে অন্তত ছয়মাসের মোটাতাজা বাচ্চাকে একবছরের বাচ্চার মতো দেখালে তা দিয়েও কোরবানী সিদ্ধ হবে। 

কোরবানীর গোসেত্মর ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘‘এবং কোরবানীর পশুগুলোকে আমি তোমাদের জন্য আলস্নাহর নিদর্শন বানিয়েছি। এতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাধাবস্থায় ওদেও যবেহ করার সময় তোমরা আলস্নাহর নাম লো। অতপর এরা কাত হয়ে পড়ে গেলে তা থেকে তোমরা আহার করো এবং আহার করাও যারা চায় না তাদের আর যারা চায় তাদের। এমনিভাবে আমি এগুলো তোমাদের জন্য বশীভহত করেছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো (সুরা হজ্জ)।  কুরবানীর গোসেত্মর ব্যাপারে ইসলামী আইন শাস্ত্রবিদদের অভিমত হচ্ছে, (১) কোরবানীকৃত গোসত্ম নিজে খাবে এবং অন্যদের খাওয়াবে।  (২) আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের দান করতে পারে। মন চাইলে সমসত্ম গোসত্মও দান করতে পারে। (৩) এক-তৃতীয়াংশ গরীবদের দান করা মুসত্মাহাব। (৪) পরিবারের সদস্য বেশী হলে দান না করলেও ক্ষতি নেই। (৫) কোরবানীর গোস্ত  বিক্রয় এবং এরদ্বারা মজুরী দেয়াও বৈধ নয়। (৬) গোসত্ম সংরক্ষণ করা বৈধ। (৭) আত্মীয়-অনাত্মীয় ধনী-গরীব মুসলিম-অমুসলিমনির্বিশেষে সবাইকে খাওয়ানো বৈধ। (৮) ভাগের ক্ষেত্রে বন্টনের সমতা রক্ষা করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা যাবেনা বরং ওজন করে ভাগ করতে হবে। (৯) গোসেত্মর সাথে হাড়-চামড়াযুক্ত থাকলে সেক্ষেত্রে অনুমান করা যাবে। এতে অনিচ্ছকৃত কম-বেশী হলে অবৈধ হবেনা।


কোরবানীর চামড়া সাদকা করে দিতে হবে অথবা ব্যবহার্য্য দ্রব্য জুতা, ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।  চামড়ার বিনিময়ে এমন জিনিস গ্রহণ করা যাবে যা পরিবর্তিত হয়ে উপকারে আসে যেমন- খাদ্য ও নগদ অর্থ। চামড়ার বিনিময়ে এমন জিনিস গস্খহণ করা যাবে যা পরিবর্তিত হওয়া ছাড়াই সরাসরি উপকাওে আসে। যেমন- চাদর,  মোজা। চামড়া বিক্রয করলে সে অর্থ গরীব-মিসকিনদের বিলিয়ে দিতে হবে। অংশীদারদেও সর্বসম্মতিক্রমে চামড়া বন্টনপূর্বক নিজেরা ব্যবহার করা যাবে। 

পরিশেষে বলা যায়, কোরবানী যেহেতু একমাত্র আলস্নাহর নৈকট্যলাভ এবং তার সন্তুষ্টির জন্যই করতে হয় সেহেতু হালাল উপার্জিত অর্থছাড়া হারাম অর্থে তা করা হঅের্থহীন। এমনকি কোরবানীর পশুতে একাধিক শরীকের একজনের নিয়তেও যদি আলস্নাহর ব্যতীত লোকদেখানো বা শুধুই গোসত্ম খাওয়ার জন্য হয়ে থাকে, তাহলে কারম্নরই কোরবানী কবুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।