কমন স্যার এবং আহত বেদনা


শাহ আলম বাদশা

স্যার, শিউলী’পা দিলো---একদৌঁড়ে এসে ফুলস্কেপ সাইজের একটা সাদাখাতা বেডের ওপর ছুঁড়ে দিয়েই ছুটে যাচ্ছিল মেয়েটা। ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে চটজলদি ডাক দেয় কায়েস, এ-ই সুমি শোন---। ততক্ষণে সে রম্নমের বাইরে চলে গেছে। ডাক শুনে ফিরে আসে এবং রম্নমে ঢুকেই ফিক করে হেসে দেয়। এটাই ওর স্বভাব, কারো মুখোমুখি হলে হাসা চাই-ই? বয়স বেশী নয়, দ্বিতীয়শ্রেণীর ছাত্রী। আর ইমরম্নল কায়েস হলো ওদের যৌথপরিবারের সবারই ’কমন স্যার !’ যদিও তার কাছে পড়ে তার ইস্কুলেরই ছাত্র, সুমির চাচাতো ভাই জুয়েল। স্যারের ডাকে ভড়কে যাওয়ায় জড়সড় হয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন ডাকলেন, স্যার? কায়েস লক্ষ্য করে খাতাটার মাঝখানে লালকালিতে বড় করে লেখা ’শিউলী’ আর ওর নিচে ছোট অক্ষরে ’ইংরেজি নোটখাতা।’ চিমত্মায়পড়ে যায় সে। হয়তোবা অন্য কাউকে দেয়ার কথা; ভুল করে সুমি তাকেই দিয়েছে, ভাবে কায়েস। তাই খাতাটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে, এটা কি আমাকেই দিয়েছে তোমার আপা?
হ্যাঁ---ঘাড় দুলিয়ে জবাব দেয় সে। 
এ দিয়ে কী করবো আমি, কেনো দিলো----
আমি কী জানি, ব্যস্---- দ্বিরম্নক্তির কোন মওকা না দিয়ে পালিয়ে যায় সুমি।

পড়nt বিকেলের মিষ্টি আমেজে কায়েসের মনে আজ কবিতা লেখার ভাবোদয় হলেও সকালের খাতার ঘটনাটাই বারবার ঘুরপাক খায় মাথায়? অগত্যা কী আর করা, খাতাটা বারকয়েক উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখে সে। কিন্তু কতগুলো ইংরেজি প্রশ্নোত্তর ব্যতীত কিচ্ছু নেই ওতে। অচেনা-অদেখা একটা যুবতী মেয়ের রহস্যজনক খাতা তাকে বেশ টেনশনে ফেলে দেয়। খাতাটা টেবিলে পশ্চিমের জানলা দিয়ে অসত্মায়মান লাল টুকটুক থালার মতো সূর্যের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে। পশ্চিমাকাশজুড়ে বিসত্মৃত বর্ণালীর রঙ্গিন আলোকমালা মেঘে মেঘে ছড়িয়ে কী অদভুত আল্পনা এঁকে দিয়েছে! রঙ্গিন পাখিগুলো দলেদলে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। একটু পরে নিস্তেজ সূর্য লুকিয়ে যাবে তার গোপন আস্তানায় আর অন্ধকারের ভয়ংকর কালো দত্যি গিলে খাবে চলমান দিনটাকে! এসব দেখতে দেখতে মাথায় একটা আইডিয়া খেলে যায় তার, তাইতো--শিউলী হয়তো ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্য খাতাটা পাঠিয়ে থাকবে। এবার সে এইচএসসি পরীক্ষার্থিণী, সুমিরই সহদরা! শিক্ষকদের এ-ই হলো বিপদ, এ বলবে এটা দেখিয়ে দাও, সে বলবে ওটা দেখিয়ে দাও--- কথাটা ভাবতেই মনে মনে হাসেও একচোট!! কিন্তু নীলাকাশের ঝুলমত্ম সূর্য কখন যে অন্ধকারের সমুদ্রে হারিয়ে যায়, টের পায়না সে। মেসমেট নুরম্নল হুদার কথায়ই হঠাৎ চমক ভাঙ্গে---কী ব্যাপার স্যার, কী করছেন? টেবিলের খাতার ওপর নজর পড়ায় ব্যঙ্গাত্মক একটা প্রশ্নও ছুঁড়ে দেন, শিউলীর খাতা যে; এখানে কেন! অত্যমত্ম লাজুক কায়েসের মুখ লজ্জায় একেবারে রাঙ্গা হয়ে ওঠে।
নাঃ মানে, ইংলিশ প্রশ্নোত্তরগুলো কারেকশন করে দিতে বলেছে তো, তাই -----আমতা আমতা করে সে।
বাহ্ ছাত্রীতো ভালোই জুটেছে একখান---আবার টিপ্পনী কাটে হুদা।
কায়েসের এ মেসমেটটি এখনো ছাত্র। আর তাকেতো এমএ পাশের পর লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে হাইস্কুলের চাকরিটা জোগাড় করতে হয়। অবশ্য এটাই তার প্রথম চাকরি এবং মেসজীবনের অভিজ্ঞতাও এ-ই প্রথম? চাকরি হবার পর এ-ই নুরম্নল হুদাই মেসমালিক সুমির দাদাকে রাজী করিয়ে তিনবেলা খাবারের জুঁৎসই ব্যবস্থাটা করে দেন। ফলে না লজিং না টিউশনি, এমন অভিনব ব্যবস্থায় জুয়েল হয়ে যায় ডবল ছাত্র। রোজ সন্ধ্যায় সে এসে একবেলামাত্র পড়ে যায় আর সময়মতো তিনবেলা টিফিন ক্যারিয়ারে আসে খাবার!

সন্ধ্যার পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে যায় রংপুর শহর। কৃষ্ণপক্ষ চলছে, লোডশেডিং না হলে হয়তো বুঝাই যেতো না। জুয়েল পড়ছে, এমন সময় বিড়ালের মতো নিঃশব্দে রম্নমে ঢোকে সুমি; কিন্তু টের পায় না কায়েস। খাতাটা কি দেখা হয়েছে, স্যার? সুতরাং সুমির প্রশ্নে ভুতদেখার মতোই চমকে ওঠে--- নাতো? আচছা দেখবো’খন, কাল নিয়ে যেও--- অপ্রস্ত্তুত অবস্থায় একদমে কথাগুলো বলে বিদায় করে দেয় ওকে। এখন অবশ্য আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে, উদ্দেশ্যমূলকভাবেই পাঠানো হয়েছে খাতাটা। পরক্ষণে ভাবে, কিন্তু কেন--শিউলীর সাথে তো কোনরকম আলাপ-পরিচয়ই হয়নি? বিষয়টাকে সাংঘাতিকভাবে নেয় এবার। তবে কি প্রেম করতে চায় নাকি মেয়েটা---এমন আজগুবি চিন্তা উদয় হওয়ামাত্র কেমন একটা পুলকিতভাবও ঢেউ খেলে যায় হৃদয়ের মধ্যে। ফলে চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে নিজেকে ধমকে ওঠে সে, ছিঃ ছিঃ, শিক্ষকতার মহান পেশায় থেকে একি ভাবছি আমি! একজন টগবগে তরম্নণ হলেও কায়েস বিয়েপূর্ব প্রেম, প্রণয় বা ভালোবাসার ঘোরবিরোধী। কেননা এধরণের প্রেমের ফাঁদে পড়ে সহপাঠি অনেক মেধাবী বন্ধুর শিক্ষাজীবন শুধু নয়, ক্যারিয়ার এমনকি উজ্জ্বল ভবিষ্যতও নষ্ট হতে দেখেছে সে। নিজেও যে ছাত্রজীবনে এমন মোহময় মরিচিকার খপ্পড়ে পড়েনি, তা নয়। কিন্তু বৈমাত্রেয় নির্যাতনের শিকার তার অসহায় মা, ভাই-বোনদের প্রতি স্বতস্ফহর্ত দায়িত্ববোধ তাকে এপথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে বারবার। এমনকি নারীরূপী বিমাতার অকথ্য নির্যাতন স্বচক্ষে দেখেশুনেই ভবিষ্যতে কোন নারীকে বিয়ের চিমত্মা দূরে থাক, এখন বরং মেয়েদের এড়িয়েই চলে।

পরদিন সকালে ইস্কুলে বেরোবার পূর্বক্ষণে খাতাটা নিযে যায় সুমি। ফলে ব্যাপারটা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মনে পড়ে, জুয়েল এক সন্ধ্যায় পড়তে পড়তে হঠাৎ বলে বসে--স্যার, শিউলী’পা না বলে, তোর স্যার দেখতে কেমনরে?ঃ
 আর তুমি কী বললে--কৌতুহলী প্রশ্ন কায়েসেরও। ঃ
 বলেছি, খুউব সুন্দর---বলামাত্রই একটা লাজুক হাসি ছড়িয়ে দেয় জুয়েল। কায়েস নিজেও লজ্জা পায় কিন্তু  সামলে নিয়ে হেসে ফেলে। আরেকদিন বইয়ের ব্যাগটা টেবিলে রেখেই গড়গড়ে বলে চলে--- চলেন না স্যার, আমাদের বাড়ীতে? এখানে গরমে পড়তে একদম ভালস্নাগেনা। কাল থেকে যাবেন কিন্তু, শিউলী’পা-ও তো আপনাকে খুব দেখতে চায়? কথা শেষমাত্র সম্মতির আশায় খুশীতে তার মুখের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে জুয়েল। 
কিন্তু আমি গেলে তোমার আপার অসুবিধে হবে যে, কায়েসও কৌতুক করেন?
নাহ্ স্যার, কিচ্ছু অসুবিধা হবেনা; যাবেন না, তা-ই বলেন--- স্যারের অনাগ্রহে এবার অভিমানে চুপ মেরে যায় সে।

মেসের উত্তরে পূর্ব-পশ্চিমমুখী একটা গলির সাথেই শিউলীদের প্রকান্ড বাড়ীটার উঁচু দেয়াল মেসটাকে পৃথক করে দিয়েছে। কায়েসসহ দু’তিনজন চাকুরে ব্যতীত মেসের সবাই ছাত্র। চাকরিতে ঢুকার পর দু’মাস কেটে যায় কায়েসের মেসজীবনের। পড়তে পড়তে আজও নতুন এক প্রশ্ন করে জুয়েল, আপনার কোন ছবি নেই, স্যার? থাকলে দ্যান না স্যার--- ।
ছবি দিয়ে কী হবে, বলো তো, কায়েসও মজাক করেন।ঃ
 বাঃ রে, আপনি আমার স্যার, আপনাকে বাড়ীর লোকজন দেখতে চায়না বুঝি? শিউলী’পা-ও তো খুব দেখতেচায়--- ওর বালসুলভ উত্তর।
আসলে কায়েস শিউলী নামের মেয়েটাকে না দেখলেও তার সম্পর্কে এত কথা শুনেছে যে, কখনো কখনো মনে হয়, সে যেন তার কত পরিচিত কত আপন? সুশ্রী যুবকের প্রতি সুন্দরী একজন তরম্নণীর এমন আগ্রহ-কৌতুহল হয়তো অস্বাভাবিক নয়, ভাবে কায়েস! তাছাড়া সে যে একজন প্রসিদ্ধ লেখক কবি ও গীতিকার, এটাও হয়তো আকর্ষনের অন্যতম কারণ। সম্প্রতি ঢাকা থেকে তার যে, গানের ক্যাসেটটা বের হলো, তা-ও হয়তো ওর আকর্ষণটা বাড়িয়েছে। তবে মজার ব্যাপার যে, তার প্রতি শিউলীর একতরফা দূর্বলতার খবরটা এখন আর গোপন নেই, জানাজানি হয়ে গেছে! তারও যে কী হলো--সুমি খাতা নিয়ে যাবার পর ইস্কুলে এসেও অহেতুক ভাবনার হাত থেকে সে মুক্তি পায়না। ঢং ঢং করে বেলবাজলেই মাত্র তার দীর্ঘ ভাবনার ইলাস্টিকটা সংকুচিত হয়ে আসে, এর আগে নয়। এমনকি ঘুমানোর আগ পর্যমত্ম  শিউলীর ব্যাপারটা মন থেকে মুছতে পারেনা। নিজেকে নিজেও সে শুধায়, আচ্ছা, মেয়েটাকে নিয়ে আমিই বা এত ভাবছি কেন; নাকি আমিও দূর্বলতার শিকার? একসময় প্রবল স্নায়ুযুদ্ধশেষে শিউলীকে চিরতরে মন সে থেকে মুছে ফেলারও সিদ্ধান্ত নেয়।

          কিন্তু ভুলতে চাইলেই কি ভোলা যায়? পরদিন বিকেলের মিষ্টি রোদেলা পরিবেশে কায়েস কী একটা জটিল লেখা নিয়ে ব্যসত্ম, সুমি আরেকটি খাতা নিয়ে হাজির? স্যার, শিউলী’পা খাতাটা দেখে দিতে বললো--প্রত্যুত্তরের কোন আশা না করে খাতা টেবিলে রেখেই দে’ দৌঁড়! কায়েস এবার রীতিমতো বিরক্তিবোধ করে। তাই রাতে জুয়েলের হাতে খাতাটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, তোমার আপাকে বলো--স্যার খুব ব্যসত্ম, দেখার সময় পায়নি। এরপর অবশ্য আর কোন খাতা পাঠায়নি সে। তবে রহস্যময়ী নারীমূর্তিটির আকর্ষণ বাড়ার পাশাপাশি তার প্রতি অযাচিত ও বাড়তি একটা আদর-যত্নের ব্যাপারও দিনদিন বেশ লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে বাড়ীর কাজের লোকই খাবার পৌঁছে দিয়ে যেতো। কিন্তু ইদানিং কখনও সুমি, ওর ভাই রোমেন কিংবা জুয়েল অথবা ওরা একযোগে সবাই হৈ-হলস্না করতে করতে খাবার দিয়ে যায়। হয়তো খেতে বসেছে, অকস্মাৎ কেউ একবাটি বাড়তি তরকারী নিয়ে হাজির--স্যার, শিউলী’পা দিলো। উদ্দেশ্য যা-ই থাক, আমার পুষ্টিবর্ধনতো ভালোই হচ্ছে---মাঝে মাঝে এমনতরো ভাবে আর হাসেও। কখনও এ-ও ভাবে, মেয়েটাকে এভাবে প্রশ্রয় দেয়া কি ঠিক হচ্ছে? পরক্ষণে মন বলে যায়--যেচে দিলে খেতে দোষ কী! এমনকি রোজ সকালে ও বিকেলে শিউলীর তরফ থেকে চা, কফি অথবা গরম দুধও আসতে শুরম্ন করে। ঘটনা এতদূর গড়ায় যে, মেসের সবার মধ্যে কানাঘুষার সৃষ্টি হয়। সুতরাং বাধ্য হয়ে নুরম্নল হুদার কাছেই পরামর্শ চায় সে। কিন্তু রসিক হুদা উল্টো মশকরা জুড়ে দেন, আরে, না-না--শিউলীর দান ফেরত দেবেন না, খবরদার! বরং যা আসে খেয়ে নিন, এটা স্বাস্থ্যের জন্য মহাউপকারী!! 
কিমত্মু বেচারী যে আদর-সোহাগে খাইয়ে-দাইয়ে একেবারে বিয়ের খোয়াব দেখছে, তার কী হবে ? কায়েস  যুক্তি দেয়--এ কি প্রতারনার শামিল হচ্ছে না; সে ভালবাসা বিলাচ্ছে আর আমি গ্রহণ করে যাচ্ছি ? 
দূর, অন্যের বাড়ি থেকে তো আর আসে না? একে বরং শিক্ষকের  উপযুক্ত যত্নই ভাবুন না কেন- হুদা মুখ টিপে টিপে হাসেন। 
আরে, সে দায়িততো প্রেমপিয়াসি ঐ যুবতীয় নয়, তা বোঝেন না কেন হুদা ভাই, কায়েস বিরক্তিপ্রকাশ করে। 
তা, না হয় বুঝলাম; তবে বিয়েটা করে ফেলেন না, ল্যাঠা চুকে যাক- নুরম্নল হুদা এবার এমনই ভাব করে বলেন যেন তিনি সিরিয়াস। ব্যস, কায়েস একদম চুপ, বিয়ের কথা উঠলেই সে লাজবাব। তার কথা-- বিয়ে কোন খেলো বিষয় নয় যে, মন চাইলো অমনি বিয়ে করে নিলাম। বিয়েতে চরম অনীহার পাশাপাশি সুচিমিত্মত যুক্তিও আছে তার। তাই বড় চাকরী বা আর্থিক স্বচ্ছলতা না আসা পর্যন্ত বিয়ের কথা মুখে আনতেও নারাজ। এমনকি এক্ষেত্রে শিক্ষা এবং পুরুষত্বকে বিকিয়ে দিয়ে যৌতুকের হলাহলে পা দেয়ারও সে ঘোরবিরোধী!
***

নুরুল হুদার কথামতো কায়েস এখন আর প্রেমসঞ্জাত প্রাপ্তিযোগে আপত্তি না করে বিনা বাক্যব্যয়ে সবকিছু খেয়ে নেয়! কিত্তু মানুষতো ফেরেসত্মা নয় যে, প্রচন্ড গতিশীল হৃদয়কেও সহজে লাগাম পরিয়ে দেবে ? ফলে মনের অজামেত্ম তারও দুর্বলতা তৈরী হয়ে যায়। রহস্যময়ী মেয়েটাকে দেখারও সাধ জাগে মনে। বিশেষ করে শিউলীর চাচা সম্পর্কের একজন মুরুববী যেদিন সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন, সেদিন থেকে কেমন একটা ভালোলাগা ভাবও অন্তরে দোলা দিতে থাকে। বিবেক তাকে প্রতিনিয়ত শাসালেও উদগ্র বাসনা দিনদিন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। এমন যুক্তিও মনে হানা দিতে শুরু করে, বিয়ে করতে হলে পাত্রীতো দেখতেই হবে? সেই দেখাটা শিউলীকেই দেখিনা কেন ? অবশেষে তার সুপ্ত প্রেমিক মনেরই জয় হলো। একবিকেল পরিকল্পনামতো সংগোপনে সে দেখে নেয় শিউলীকে। মানানসই সেলোয়ার কামিজের পাশাপাশি আকর্ষণীয় ওড়নায় মাথাঢাকা থাকলেও মিষ্টি মুখখানা চিনে নিতে একটুও কষ্ট হয়না। সুশ্রী মুখচ্ছবিটা যেন অমত্মরে একদম আঁকা হয়ে যায়। এরপর অবশ্য একদিন মাত্র মুখোমুখি দেখা হয় দুজনার, সেও দৈব্যক্রমে। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে মেসের গলিতে বাঁক নিতেই দেখে, সেই অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানা। ওদের গেটের সামনের বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিক্য্রা বিদায় করছে। হঠাৎ চোখাচোখি আর মুচকী হাসির বিনিময় হয়ে যায়। 
       সময় থেমে থাকে না। বরং বছরখানিক যেন দ্রম্নত কেটে যায় শিক্ষকজীবনের। প্রতিমাসে লালমনিরহাটে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের দেখে আসে কায়েস। সাতবছর যাবত সে তাদের ভরন-পোষন করে। সে এক করম্নণ ইতিহাস। তখন সবেমাত্র পঞ্চমশ্রেণীর ছাত্র সে। মা’র অসুস্থতার অজুহাতে তার প্রিয় বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে বসেন। শীঘ্র অসুস্থ মা আরোগ্যলাভ করলেও সর্বনাশ যা হবার তা হয়েই যায়। সমত্মানবাৎসল্য পিতার মতিগতির অস্বাবিক পরিবর্তন ঘটে। ফলে তাদের বিমাতার মন জুগিয়ে চলা ছাড়া আর গত্যন্তর থাকেনা। অন্যথায় শারিরীক নির্যাতন কিংবা আরোপিত অনশন হয়ে দাঁড়ায় তাদের ভাগ্যলিপি। সৌভাগ্যবশত: প্রাথমিক ও জুনিয়রবৃত্তি পাওয়ায় এসএসসি র্পযন্ত পড়াশুনাটা স্বাচ্ছন্দে চালিয়ে নিলেও ইন্টারমিডিয়েটে এসে সব লনডভন্ড হয়। দুঃখিনী মায়ের বুকফাঁটা কান্নাও তাদের বিপর্যয়রোধ করতে পারে না। একতরফাভাবে জুদা করে দেয়া হয় তাদের । সুতরাং সমসত্ম ভরন-পোষণের দায়ভার এসে চাপে জাগ্রতবিবেক কিশোর কায়েসের ঘাড়ে। তখন থেকে অবিরাম টিউশনী হয় তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। পাশাপাশি ডাক্তারী পড়ার সপ্নসাধকে চিরবিসর্জন দিয়ে কোনমতে এমএ পাশের পর তাকে ছুটতে হয় যেনতেন একটা চাকরীর পেছনে।

চলতিমাসেও বেতন নিয়ে বাড়ী চলে যায় সে। দু’দিন পর আজই চলে আসে ভারাক্রামত্ম মনে। মা’র খুব অসুখ, মরণাপন্ন অবস্থা। বহু টাকার দরকার। মা কি তবে বিনাচিকিৎসায় মরে যাবে- মনে তার কাঁন্নার প্রবল উচ্ছ্বাস! এ মুহুর্তে সোনালী মধুর বিকেলটাকে কেন যেন মনে হয়, তার মায়েরই পান্ডুর মুখ। শিউলির মায়াভরা মুখ কিংবা মধুর স্মৃতিগুলোও ভালস্নাগে না আর। অতএব কাপড়চোপড় পাল্টিয়ে বের হয়ে পড়ে টাকার ধান্ধায়।
       ঠিক এশার পর মেসে ফেরে সে। অবসন্ন-ক্লামত্ম দেহটা ঘুমাতে চায় কিন্তু ঘুমের বদলে রাজ্যের টেনশন তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে। কাঙ্খিত অর্থের জোগার হয়নি এখনো। খুব ভোরে আরেকবার বেরোতেই হবে। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকে যতসব আকাশ-পাতাল। মাস্টার সাব, আছেন নাকি- রহিম চাচার ডাকে চিমত্মার জাল সহসা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ইনি শিউলীর আতীণয়, বেশ রাশভারী লোক।
       ঃ চাচা আছি, আসেন ভেতরে আসেন, কায়েস ঝটপট স্বাভাবিক হয়ে সাড়া দেয়।
       ঃ কী ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি এলেন যে এবার, বাড়ীর খবর ভালো তো?
       ঃ ইয়ে, মানে হ্যাঁ চাচা- কী বলবে জবাব খুজে পায় না সহসা।
       ঃ তা, জরম্নরী একটা ব্যাপারে এলাম। আপনি তো আবার ক্লান্ত- তিনি কথাপাড়ার মওকা খোঁজেন যেন।
       ঃ না, না--বলুন অসুবিধে নেই, কথা কেড়ে নিয়ে সম্মতি দেয় কায়েস।
       ঃ তাহলে মেসে নয় বাইরে চলুন- এ প্রসত্মাবে ঘাবড়ে যায় সে, কী বলবেন ইনি, কিসের জরম্নরী কথা? অনাহুত টেনশনে ঢিব ঢিব করতে থাকে বুক। মুর্হুতে অন্যজগতে চলে যায় সে, এমনকি অসুস্থ মায়ের কাতরানীর কথাও ভুলে যায় সে। এ-ই তার দোষ। কেউ জরম্নরী কিছুর আভাস দিলেই হলো- না শোনা পর্যমত্ম বুক দুরম্ন দুরম্ন বাড়তেই থাকবে। শিউলীর ব্যাপারে কোন অভিযোগ নয়তো- সন্দহটা অমত্মরে উঁকি দেয়ামাত্র একটা অপরাধবোধও জাগে মনে।
       ঃ কথা হলো কী, শিউলীর তো বিয়ের কথাবার্তা চলছে? আপনি, মানে শুনেছিলাম- আমতা আমতা করেন চাচা। কায়েসের নাড়ীর গতিও বেড়ে যায় যেন। হ্যাঁ, শুনে ছিলাম শিউলী আপনার ব্যাপারে খুব আগ্রহী আর আপনিও নাকি অর্থাৎ আপনার মতামতটা আর কী- তার শেষকথায় মাটিতে মিশে যাবার অবস্থা কায়েসের। তবু নিজেকে সামাল দিয়ে দ্রম্নত একটা সিদ্ধামত্ম নিয়ে ফেলে। নাহ- এভাবে আর লুকোচুরি নয়। শিউলীর স্মৃতিগুলো এমূহুর্তে কেন যেন বিষের ফলার মতো বিঁধতে থাকে হৃদয়ে। এক্ষণে সবকিছু ছাপিয়ে মৃতপথাযাত্রী মায়ের ফ্যাকাশে মুখটাই আবার চোখের সামনে ভাসতে শুরম্ন করে। হ্যাঁ- তাকে মায়ের মুখেই হাসি ফোটাতে হবে আগে? প্রবল দ্বন্দ্বে পড়ে অথৈই সাগরে কিছুক্ষণ হাবুডুবু খায় সে।
       ঃ কী মাস্টার, চুপ থাকলেন যে, কিছু বলেন- চাচার প্রশ্নে বাসত্মবতায় ফিরে আসে আবার।
       ঃ জ্বী চাচা, আসলে কাউকে ভালোলাগাটা দোষের কিছু নয় বরং স্বাভাবিক। কিন্তু আমার অবস্থাতো জানেন, নিতামত্ম বাধ্য হয়ে সামান্য বেতনের চাকরী করি। মানে, বুঝতে পারছেন বয়স হলেও বিয়ের কথা এখন ভাবছিনা। এতটুকু বলে কায়েস এমন একটা দূর্বোধ্য অথচ অস্ফুট হাসি ছড়িয়ে দেয়, যার মর্মোদ্ধার বড়ই কঠিন।
       ঃ এই কথা আপনার? রহিম চাচার কন্ঠে আহত বিস্ময়, বহুত ধন্যবাদ, খুশি হলাম শুনে- এ বলে যেন কিছুটা ঘৃণাচ্ছলেই হন্ হন্ করে চলে যান তিনি।

       কখন ফজর নামাজ শেষ হয়েছে। লাল টুকটুক শাড়ীপড়া সূর্যটা সবেমাত্র পূর্বাকাশে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আজ নিত্যদিনের চেয়ে একঘন্টা আগে নাসত্মা আসার কথা। তীর্থের কাকের মতো তাই অপেক্ষায় আছে কায়েস। এক্ষূনি টাকার খোঁজে বেরোতে হবে। অতপর ধরতে হবে আটটার বাস। চরম উৎকণ্ঠায় কাঁপছে যেন। এমন সময় কাজের লোক নাস্তা নিয়ে হাজির। ভূতদেখার মতোই চমকে ওঠে সে। আরে, ইনিতো নাসত্মা দেন না কখনো- ! মনে পড়ে, প্রথমদিকে দু’একদিনমাত্র এ বৃদ্ধলোকটি খাবার নিয়ে এসেছেন। এরপর আর কোনদিন আসেননি।
       ঃ আজ হঠাৎ আপনি যে, সুমিরা কেউ নেই নাকি- অকস্মাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় প্রশ্নটা। না বাহে, সগায় (সবাই) আছে, শিউলীই ওমাক (ওদের) আইসপার (আসতে) দিলো না। ওমরা (ওরা) আর আইসপার (আসবে) নয় (না)। এ্যালা (এখন) থাকি মুই আসিম (আসবো)-- বৃদ্ধ একটানে বলে যান কথাগুলো।
       ঃ কেন কী হয়েছে-- তাজ্জ্বব বনে যায় যেন? ততক্ষণে মনেমনে কিছু একটা অাঁচও করতে পারে বোধ’য়।
       ঃ কী জানি বাপু(বাবা) কাইল আইত(রাত) থাকি শিউলী মা’র যে কী হইছে, কবার(বলতে) পাংনা(পারিনা)। মনটাও খুব খারাপ। আইতোৎ(রাতে) শুতি শুতি (শুয়েশুয়ে) কাঁনছেও(কেঁদেছেও) ম্যালা(অনেক)। আচ্ছা বাহে- মুই গেনু(গেলাম) বলে আর দাঁড়ান না তিনি। সংগে সংগে কায়েসের অমত্মরটাও আহত বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। সেখানে বয়ে যায় প্রবল জলোচ্ছ্বাস এবং প্রচন্ড একটা ঝড়!!