মনের পর্দা আসল পর্দা (রম্যরচনা)


'পর্দা’র বিষয়ে লিখিতে বসিয়া বড়ই টেনশন ফিল করিতেছি। না জানি, কাহার গাত্রে আবার দাউদাউ করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠিলো? কেহ আমার চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধারেও উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়া গেলেন কিনা, তাহা ভাবিয়া সত্যই আশংকাবোধ করিতেছি! কেহ চটিয়া থাকিলে বিনীত করজোড়ে বলিতেছি, চটিবেন না। কারণ আমার কথাতো এখনো শুরুই হয় নাই, কিংবা শেষও করি নাই; পুরাপুরি না শুনিয়া অযথা চটিবার কী আছে? অবশ্য অনেকের আবার এমন বাতিক আছে কিনা, কাহারো জবানে অপ্রিয় সত্যকথা শুনিলেই ব্যস, আর যায় কোথায়! আগাগোড়া শোনা দূরের কথা, তাহাদের অযোক্তিক লম্ফ-ঝম্ফ শুরু হইয়া যায়।

তেমনি ’পর্দা’ বলিতেই যাহারা অজ্ঞান, তাহাদেরও আনন্দিত হইবার কোনো কারণ নাই। আমি পর্দা’র ওয়াজ কিংবা উহার গুণগান করিতেও কলম ধরি নাই! বরং আমার মনের পর্দায় ঢাকা কতক দুঃখ-বেদনার গুঁমোট কাহিনী শুনাইতেই এতো কথার প্রলাপ বকিতে হইতেছে, আরকি? আমি অনলবর্ষী কিংবা নামকরা বক্তাও নই, তাই ভুল-ত্রুটি হইলে এই কমবক্তার উপর দোহাই কেহ ক্রুদ্ধ হইবেন না। আমার ঠিক ’হাইপার টেনশনব্যামো’ আছে কিনা- তাই হঠাৎ অক্কা পাইবার সমূহসম্ভাবনা রহিয়াছে। অতএব দয়া করিয়া অযথা রাগ করিবেন না। নতুবা এ অধম অক্কা পাইলে পর্দা টাংগাইয়া গোছল করাইতে কিংবা কাফন পরাইয়া কবরস্থ করিবার মতো ধকল নির্ঘাত আপনাদেরই সামলাইতে হইবে।

যাহাই হউক, আজকাল পর্দা’র বহুত রকমফের বাহির হইয়াছে বলিয়া শুনিতেছি, আপনারাও নিশ্চয় শুনিয়া থাকিবেন? মনের পর্দা, চোখের পর্দা, কানের পর্দা, ঘরের পর্দা, দরজার পর্দা, জানালার পর্দা, আরো কত কী? তওবা, তওবা- আরেক পর্দার কথাতো বেমালুম ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। ভুলিয়াইবা যাইবোনা কেনো- সেকেলে সাম্প্রদায়িক হইবার ভয়তো আমারো থাকিবার কথা। কাজেই মাঝে মাঝে না ভুলিলে চলিবেই বা কেমন করিয়া? ইদানিং পত্রিকার পাতা খুলিলেই শরীর কাহার না শিহরিয়া ওঠে! এতোসব সুরক্ষিত পর্দা ভেদ করিয়া ঘরের বাহিরের যতোসব বেপর্দা কান্ডের খবর শুনিয়া শুনিয়া তো আমার কানের পর্দাটাই টুটিয়া যাইবার উপক্রম হইয়া পড়িয়াছে? নারীধর্ষণ, শিশুধর্ষণ, ছাত্রী-শিক্ষকধর্ষণ, গণধর্ষণ, সহপাঠিনী ধর্ষণ, কাজের বুয়াধর্ষণ, শ্যালিকাধর্ষণ,  ঘরে ধর্ষণ, বাইরে ধর্ষণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে  ধর্ষণের সেঞ্চুরীপালন, ধর্ষণের ভিডিওনির্মাণ, কলগার্ল, সেক্সগার্ল, মক্ষীরাণী, পতিতাসর্দারনী, ইয়াবাসমাচার, ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী, পতিতাবৃত্তি, নারীশিশুপাচার, জ্বেনা-ব্যাভিচার, পরকিয়া, অসমপ্রেম, এসিডনিক্ষেপ, ইভটিজিং ইত্যাদি অহরহ ঘটিতেছে দেখিয়া কতক ব্যাকডেটেড আলেম সাহেবানদের মুখে আমি প্রায়ই শুনিতে পাই--আহা, পর্দাপ্রথা, শালীনতার চর্চা থাকিলে কি আর এতোসব আকাম-কুকাম ঘটিতে পারিতো! আগুনের সাথে মোমের বসবাসের পরিণতি এমনই তো হওয়া  স্বাভাবিক? নর-নারীদের আলাদা আলাদা কর্মক্ষেত্র থাকিলে কি এমন পশ্বাচার আর নারীদুর্গতি  দিনের পর দিন বাড়িতেই থাকিত!! বৈষয়িক উন্নয়নের পাশাপাশি নারীদের দুর্গতি বাড়িয়া যাওয়াটাও কি তবে আধুনিক উন্নতির লক্ষণ নাকি?   কই, আগের দিনে তো এতো বেশী নারীনির্যাতন আর নারীদের দুর্গতি দেখি নাই ইত্যাদি ইত্যাদি?

তাহাদের আফসোসের কথা যুক্তিযুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত কিনা ভাবিয়া দেখি নাই; কিন্তু প্রগতিশীল ভদ্র মহিলাদের উন্নতির প্রচন্ড গতির কথা না ভাবিয়াও পারি নাই। ঠিকই তো, একবিংশ শতাব্দীর চরম অগ্রগতির যুগেও মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতিত মাতৃজাতিকে পর্দার অন্তরালে শুধু সন্তান জন্মদান আর প্রতিপালনের জন্যই কোনঠাসা করিয়া রাখিবার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ থাকিতে পারে কি? তাহাদের সেবা, রূপ-সৌন্দর্যকে পারিবারিক গন্ডিতে আবদ্ধ রাখিয়া একজনমাত্র পুরুষইবা কেনো শুধু ভোগ করিবে, তাহা হইতে গোটা জাতিকে বঞ্চিত রাখা কি সত্যই বৈষম্যমূলক হইতেছে না!  আর যাহারা বহুবিবাহের আদলে বহুস্বামীও রাখিতে চান কিংবা বহুস্বামীর নিত্য মারামারি-লড়াইয়ের হাত ও সামাজিক লজ্জা হইতে জীবন বাচাইতে পুরুষপতিতালয়ও বানাইতে চান; তাহা হইতে বঞ্চিতের অধিকার কে দিয়াছে  মোল্লাদের?? সেকেলে মা, খালা, ফুফু, চাচী, নানী, দাদীদের মতো একেলে নারীদের এতো বোকা ভাবিয়া প্রকৃতপক্ষে পুরুষসমাজ দেশ-জাতির কতই না ক্ষতিসাধন করিয়া চলিয়াছে। ‘নদী কভূ পান নাহি করে নিজ জল, তরুগন নাহি খায় নিজ নিজ ফল।‘ অথবা ’’ফুল ফোটে অপরের জন্য’ এইসব চিরসত্য কথার অনুসরণে নিত্যনতুন কসমেটিক্সের উগ্রগন্ধ মাখিয়া এবং বাহারী সাজে সজ্জিত হইয়া উলংগ- অর্ধ উলংগ পোশাকে এমনকি জাঙ্গিয়া-পেন্টি পর্যন্ত পরিধান করিয়া প্রজাপতির মতো  কুস্তি লরিতে বা সাঁতার কাটিয়া যদি বেড়ানোই না গেলো, তবে আদমকে গন্ধম খাওয়াইয়া নারীজীবনকে সার্থক করিবে কে!

সেদিন টিভিতে সেক্সি সাজে সজ্জিত কতিপয় উঠতি বালিকার ডিস্কো নৃত্য শুরু হইতেই আমার মুখ ফসকাইয়া হঠাৎ বাহির হইয়া গেলো--ছিঃ ছিঃ, অবুঝ শিশুদের এখন হইতেই দেখি সেক্সি করিয়া তোলা হইতেছে, পুরুষের মাথা গরম হইবেনা কেনো আর নারীনির্যাতন বাড়িবেই বা না কেনো? ভাবিলাম, কাহারো সমর্থন পাইবো। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, সেই আশায় গুড়ে বালি। রক্তচক্ষু পাকাইয়া এক ভদ্রলোক চেঁচাইয়া উঠিলেন, আরে মিয়া রাখেন ওইসব বাজে কথা; মনটাকে আগে উদার করেন। বলিলাম, কেমন উদার?
ঃ আপনারা সবকিছুতেই শুধু ইসলাম আর সেক্স খোজেন কেনো, বলুন তো! নাচতো সুন্দর একটা শিল্পকর্ম, এই বালিকাদের নিজের মা-বোন বা মেয়ের মতো ভাবিলেই তো পারেন। আসলে, নিজের মনটা ঠিক থাকিলেই হইলো বুঝিলেন--চরম বিরক্তির সাথে বেচারা গড় গড় করিয়া এই গরম কথাগুলি বলিয়া ফেলিলেন! সেকেলে প্রমাণিত হইবার ভয়ে কথা না বাড়াইয়া আমিও চুপ মারিয়া গেলাম। তবে মনে মনে বলিলাম, সরকার আমাদের সবাইর মা, মেয়ে, বোন, বউদের বাধ্যতামূলকভাবে এই মহৎ শিল্পকর্মে নিয়োজিত করিলেই তো পারে, আয় রোজগারও হইবে আর লক্ষ জনতাও মনকে ঠিক রাখিয়া নয়নকে সার্থক করিবে এবং এমন পবিত্র নৃত্য দেখিয়া জাগ্রত কামত্তেজনাকেও বীরপুরুষের মতো ঝাড়িয়া ফেলিয়া ধর্ষণবিরোধী এবং মহাশিক্ষক পরিমলবিরোধী তীব্র গণআন্দোলন গড়িয়া তুলিবে।

হায়, যেইখানেই যাই সেইখানেই শুধু এই মন ঠিক রাখা আর ‘মনের পর্দা’র ব্যাপার-স্যাপার শুনিতে শুনিতে আমার কান ঝালাপালা হইয়া গেলো। কী আশ্চর্য ব্যাপার, যেই সকল একেলে নারীর উগ্র ঝাঁঝালো গন্ধে বিভ্রান্ত ভ্রমর নিত্য পিছু লয়, কিন্তু বাসে, ট্রেনে বা পথে অনিচ্ছায়ও কেহ তাহাদের গায়ে হোচট বা ধাক্কা খাইলে তাহারাই আবার চেঁচাইয়া ওঠেন, এইযে, চোখে দেখেন না--চোখের পর্দা নাই বুঝি? অথচ তাহারাই আবার পর্দা’র কথা শুনিলে অকপটেই বলিয়া ফেলেন, পর্দা-টর্দা কী, মনের পর্দাই আসল পর্দা? সত্যি, আমার মনের পর্দায় ঢাকা দুঃখগুলির কথা, তবে কি প্রকাশ করা ঠিক হইবে না! মনের পর্দাই কি তবে আসল, আর চোখের পর্দার বাহিরের সবই কৃত্রিম-নকল? বুঝিলাম, মনের বাহিরের সকল পর্দা এমনকি শরীরের পর্দাও অহেতুক জঞ্জাল! তাইতো, কোনো মহান নারী নয় কেবল পুরুষশাসিত সমাজের উদার মহান পুরুষদের আন্তরিকতায় এখন নিছক ব্রেসিয়ার, পেন্টি বা অন্তর্বাস, হাফপ্যান্ট, হাতাকাটা ব্লাউজ বা জালিকামার্কা শাড়ী পরিয়া আমাদের মাতা-ভগিণীরা সর্পিলগতিতে হাঁটিয়া চলিলে অথবা প্রকাশ্য জলে সাঁতার কাটিলে,  কুস্তি লড়িলে বা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হইলে কিংবা প্রেম অথবা তারকা জগতের হিট নায়িকার সুনাম পাইতে এমনকি  প্রভাদের  মত  ভদ্র পতিতা সাজিলেও কাহারো পক্ষে শাসন করিবার বা কিছু বলিবার সাধ্য নাই। আর দুর্বল ঈমানদার বা মনের পর্দায় মহাদুর্বল উজবুকগণ টিভি-সিনেমায়, নাটকে-অনুষ্ঠানে বা পথে-ঘাটে এইসব প্রজাপতিদের রূপ দেখিয়া লোলুপ হইয়া বেসামাল কান্ড ঘটাইলেই তো ঘটিবে নারীনির্যাতন, আর অঘটন না ঘটাইতে পারিলেও তাহাদের ঠোঁট চাটিয়া অন্তর ফাটাইয়া আফসোসে চলিয়া যাওয়া ছাড়া তো কোনো গত্যন্তরও নাই!

সেদিন দেখিলাম, জনৈক মনের পর্দাওয়ালী পত্রিকার পাতায় লিখিয়াছেন যে, ‘’তিনি লকলকে বাড়ন্ত বিরাট এক দেহ লইয়া অনায়াসে তার কলেজজীবন পার করিয়া দিয়াছেন, তবুও পর্দাতো দূরের কথা কখনো ওড়না নামক জঞ্জাল্টাও পরেন নাই।‘‘ আমার এক বন্ধু এই লেখা পড়িয়া তো তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিয়া বেফাঁস বলিয়াই ফেলিলেন, হারামজাদী-বাকী কাপড়টুকুও না পরিলেই তো পারে। তুই না হইলি মানুষ আর না হইলি বনের পশু, রইলি নিছক মনের পশুরে!! আমার করার কিছুই ছিলোনা; বরং তাহার সমর্থনে আমাকেও বলিতে হইলো--বেচারীর মনের পর্দা এখনো পাকাপোক্ত হয় নাই কিনা, তাই পোশাক ছাড়িতে সময় লাগিতেছে। ধৈর্য ধরো বন্ধু।

ছেলেদের মতো মেয়েদেরও শুধু অন্তর্বাস পরা, হাফপ্যান্ট বা নগ্ন পোশাকে বা শরীরে চলাফেরা জায়েজ কী নাজায়েজ বলিতে পারিনা, কিন্তু পর্দা করা বা শালীন পোশাকপরা সব ধর্মেই ফরজ তাহা শুনিয়াছি। তাইতো দেখিতে পাই, পুরুষরা নির্লজ্জের মতো খোলা জায়গায় পেশাব করিলেও কোন ধর্মের মেয়েরাই  এমনকি পেন্টি পরিহিতা কোন নারীও তা কখনও করিতে পারেনা কিংবা পারে নাই। তাই আলেম-ওলামারাই বলেন যে, লজ্জা ঈমানের অংগ এবং প্রকৃতপক্ষে লজ্জাই হচ্ছে আসল পর্দা? সেজন্যই পর্দা না মানিলে দুলাভাই শালিকার জন্য পাগল হইয়া যায় এমনকি শালিকা আপন বোনের সংসারও ভাঙ্গিয়া ফেলে, একজনের বউ আরেকজনের সাথে চুটাইয়া প্রেম বা পরকিয়া করে কিংবা সন্তান ছাড়িয়া পরপুরুষের সাথে পালাইয়া যায়। কারো মেয়ে অপরের ছেলের সাথে আকাম-কুকাম বা লিভ টুগেদার করে, প্রেমের নামে ধর্ষিতা হয় অথবা প্রাণপ্রিয় পিতামাতার মুখে চুনকালি মাখাইয়া ভাগিয়া যায়। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার দরুণ মেয়েরা প্রেমিকের পর্ণোগ্রাফীর শিকার হইয়া আত্মহত্যার পথ বাছিয়া লয়, পনবন্দী হইয়া পতিতাবৃত্তিতে নামে কিংবা পাচার হইয়া যায়। কখনো-সখনো তাহাদের প্রেমলীলার শিকার হইয়া পিতামাতার মৃত্যও অবধারিত হইয়া যায়?

উদ্দাম-অশ্লীল নৃত্যগান, অবাধ মেলামেশা, সহশিক্ষা, নগ্ন বা পর্ণোগ্রাফী পত্র-পত্রিকা, অশ্লীল নাটক-সিনেমা, আকাশ সংস্কৃতি, পর্ণোসাইট ইত্যাদিই নারীদূর্গতি বা নারীনির্যাতনের সকল রাস্তা খুলিয়া দেয়-- এসব মাধ্যমেই তো মেয়ে বা নারীর পেছনে নায়কের কুকুরের মতন লাগিয়া থাকা কিংবা ইভটিজিং করিতে করিতে নারীকে নিজ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করিয়া লওয়ার ট্রেনিং দিয়া থাকে? এহেন শক্ত কথাবার্তা অভিজ্ঞ মুরুব্বীরাই তো বলিয়া থাকেন। তাহাদের কথা বা অভিজ্ঞতা সঠিক-সত্যি কিনা জানিনা, তবে তাহাদের কথা অহরহ সত্য প্রমাণিত হইতে দেখিয়া উহাতে বিশ্বাস না করিয়াও পারি না। এইজন্যই তো এই হতভাগার সহিত কতজনেরই না তর্কবিতর্ক হইয়া যায়! এমনকি আমার বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠির শ্রাদ্ধ যে কতজনে কতবার করিয়া ছাড়িয়াছে, তাহা লিখিলেও সাতখন্ড রামায়ন হইয়া যাইবে বলিয়া আশংকা করিতেছি।

ছাত্র-শিক্ষক, পুলিশ কিংবা বিবাহিত-অবিবাহিতনির্বিশেষে পুরুষ কর্তৃক তানিয়া বা ইয়াসমিনের মতো হাজারো শিশুধর্ষণ, নারীধর্ষণ ইত্যাদি অহরহ কেনোই বা ঘটিয়াই চলিয়াছে? এতো আইন-আদালত, বিচার-ব্যবস্থা থাকিবার পরও কেনো নারীনির্যাতন বন্ধ হইতেছে না বরং বাড়িয়াই চলিয়াছে, তাহার হিসাব মিলাইতে গিয়া আমি বহুত হয়রান হইয়া গিয়াছি। পর্দাপন্থীরা তাই দাপটের সাথেই দাবী করিয়া থাকেন যে, পর্দাপ্রথাকে যতই অবরোধব্যবস্থা, সেকেলে, মধ্যযুগীয় বা পশ্চাৎপদ কিংবা জেন্ডার বৈষম্যমূলক বলা হউক না কেনো, নারীরা যতদিন পর্দার মধ্যে শালীনতার মধ্যে কিংবা আলাদা কর্মক্ষেত্রে বিচরণ করিয়াছিলো, ততদিন পর্যন্ত অন্তত আমাদের দেশের নারীদের এই দূরাবস্থা কখনোই ছিলোনা। নারীশিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়াও তাহার কোনো লেখায় কখনোই এই উপমহাদেশে এমনসব অভিনব ও নোংরা আকাম-কুকাম বা নারীনির্যাতন সংঘটনের বিরুদ্ধে কথা বলেন নাই। তিনি শুধু পর্দার নামে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার নামে মুসলিম নারীজাতিকে ইসলামনির্দেশিত বাধ্যতামূলক জ্ঞানার্জন বা শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখিবার বিরুদ্ধেই নারীজাগরণের ডাক দিয়া সফল হইয়াছিলেন? তিনি তো নারীস্বাধীনতার নামে নিজেও বেপর্দা বা বেপরোয়া পোশাকে চলাফেরা করেন নাই কিংবা অন্যদের চলিবার উৎসাহও দেন নাই। এমনকি তিনি কোনোরূপ সহশিক্ষা নহে বরং নারীদের ইসলামনির্দেশিত পৃথক শিক্ষাক্ষেত্র বা কর্মক্ষত্র চালুর দাবীই করেছিলেন এবং বাস্তবে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা দেখাইয়াও গিয়েছিলেন। এখন তো বিশ্বের মধ্যে একমাত্র ইরানেই ৬০%  নারী চাকরী করিয়া জীবিকানির্বাহ  করিতেছে---নারীরা আন্তর্জাতিক খেলাতেও অংশগ্রহণ করিতে পিছপা হইতেছে না; কই সেইখানে তো নারী নির্যাতনের  এমন ধস দেখা যায়না? ইরানের সিনেমাও তো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাইয়া থাকে।  আর হলিউড , বলিউডসহ আমাদের মহান উদার প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে নানান ছদ্মাবরণে এবং শিল্পের নামে মানুষের পশুত্ব শক্তিকে এমনভাবে উস্কাইয়া দেয়া হইতেছে যে, মানুষ আর মানুষ থাকিতে পারিতেছে না বরং বন্যপশুর রূপধারণ করিয়া চলিয়াছে। নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুশাসনকে অবজ্ঞার ফলে আজ নারী-পুরুষের মাঝে শালীনতাবোধ বা লজ্জার আবরণ ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া পড়িয়াছে এবং পাশ্চাত্যের পশ্বাচারনীতি চালু হইয়া যাইতেছে বলিয়া বেসামাল পুরুষ নারী-শিশুদের ওপর হিংস্র জানোয়ারের মতো দ্বিগুণ-ত্রিগুনমাত্রায় ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে। এইসব দাবী কিন্তু আমার নহে বরং পর্দাপন্থীদের!
 
এই হতভাগা পত্রিকায় পড়িয়াছে যে, আমেরিকার স্কুলগুলিতে শিশুমাতার সংখ্যা দিনদিন আশংকাজনক হারে বাড়িয়াই চলিয়াছে। তাই শিশু ছাত্রীদের গর্ভরোধে ছাত্রদের সাথে বাধ্যতামূলকভাবে কনডম রাখিবার নির্দেশ জারী করা হইয়াছে। এমনকি সেই পাশ্চাত্য বা আমেরিকাপন্থীদের ফ্রীসেক্সের দেশেও এক সেকেন্ডের জন্য বিদ্যুত চলিয়া গেলে হাজার হাজার নারী-শিশুও বা কেনো ধর্ষিতা হইয়া থাকে, তাহার জবাবও আমি প্রগতিবাদীদের ঝুলিতে খুঁজিয়া পাই নাই।

সেদিন আরেক পত্রিকায় দেখিলাম, জনৈকা লেখিকা লিখিয়াছেন যে, ‘’পর্দা প্রগতির অন্তরায়, সেকেলে প্রথা। যাহাদের মন শত কুসংস্কার কুচিন্তায় পরিপূর্ণ এবং যাহারা অর্ধ-শিক্ষিত নারী তাহারাই অর্থহীন পর্দাপ্রথার ধারক-বাহক। প্রকৃতপক্ষে, মনের পর্দাই আসল পর্দা ইত্যাদি।‘’ লেখিকার এতোসব কথার জবাব তখন আমার জানা ছিলোনা। তাহার মনের পর্দা’র অন্বেষণেও তখন অনেক পন্ডশ্রম করিয়াছি কিন্তু সোনার হরিণ কোথায়ও খুঁজিয়া পাই নাই। মনের পর্দাটাই বা কী, কোথায় থাকে, দেখিতে কিরূপ সকল বাংলা ডিকশনারি ঘাটিয়াও আজ পর্যন্ত তাহার উত্তর মিলাইতে পারি নাই। কলেজজীবনে এক সহপাঠিনীর কাছেও ওই একই কথা বহুবার শুনিয়াছিলাম। একদিন তাহাকে বলিলাম, শালীনতা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য পর্দা দিয়া জন্য ঘর, দরজা, জানালা, ভাত-তরকারী, মূল্যবান বস্তু ইত্যাদি ঢাকিয়া রাখিতে হয়, কিন্তু তোমাদের ঐ মনের পর্দার কাজটা কী? কোনদিন তাহার কাছেও উহার সদুত্তর পাই নাই। অথচ তাহাকে আরেক সহপাঠির সহিত দেহ ও মনের সেই মহামূল্যবান পর্দা তছনছ করিয়া দিব্যি লিভ টুগেদার করিতেই শুধু দেখিয়াছি। শুনিয়াছি ডাক্তারগণ বলেন যে, পর্দাসমৃদ্ধ বা আচ্ছাদিত খাবার-দাবার ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত, নিরাপদ ও তাজা থাকে। অন্যথায় শত্রুর আক্রমনে তা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া পড়ে। তেমনি জ্ঞানীজনরাও বলেন যে, শালীনতায় বা পর্দায় বা আলাদা কর্মক্ষেত্রে থাকিলে নারীরাও নিরাপদ থাকে এবং অতীতেও ছিলো বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। যেমন বনের বাঘ, সিংহ, হায়েনার সহিত একই কর্মক্ষেত্রে বিচরণ করিয়া হরিণরা কখনোই নিরাপদ থাকেনা।

হায়, আসল কথাই বলা হইলোনা। থাউক আমার মনের পর্দায় ঢাকা বেদনাগুলি গুমড়িয়া কাঁদিয়া মরিলেও আর বাহির করিবো না। যথাস্থান হইতে নামাইয়া আনিয়া উহাদের বেপর্দাও করিতে চাহি না। শুধু প্রগতির ঢোল বাজাইয়া বলিতে চাহি---‘’ মনের পর্দা আসল পর্দা, বাহিরের পর্দা ঘুচাওরে---।‘’