30.5.11


 দৌলতদিয়া যৌনপল্লী
নারী-শিশুদের অসামাজিক জীবনের অবসান চাই?
শাহ আলম বাদশা

পতিতাবৃত্তি বা যৌনপেশা একটি ঘৃণ্য অথচ আদিম পেশা, যা নারীকে সামাজিক স্বীকৃতিহীন ভোগ্যপণ্য ও যৌনযন্ত্র হিসেবেই মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে থাকে। কোন সমাজ এবং ধর্মেই এ পেশার স্বীকৃতি ও মর্যাদা না থাকলেও স্বার্থান্বেষীমহল কর্তৃক পেশাটি একবিংশ শতাব্দীর চরম উৎকর্ষের যুগেও বিস্ময়করভাবে টিকে আছে। আধুনিক সমাজ যৌনপেশায় নিয়োজিত মানবেতর নারীদের শ্রেষ্ঠজীব হিসেবে সমাজে পুনর্বাসিত কিংবা প্রতিষ্ঠিত করতে সম্পূর্ণরূপেই ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।

অবশ্য ইসলামধর্ম নারীকে যৌনদাসত্বের হাত থেকে রক্ষা করেছে পবিত্র বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে সামাজিক ও এইড্সমুক্ত জীবনযাপনের সুযোগ দিয়ে। আর পশু-পাখিদের মত অবাধ যৌনসম্পর্ককে করেছে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও নিরুৎসাহিত। কেননা মানুষের মধ্যে মনষ্যত্ব ও পশুত্ব- এ দু’গুণের স্বাভাবিক সমন্বয় থাকলেও মনুষ্যত্বের কারণেই সে আজ শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন। মানবসমাজে মনুষ্যত্ব ব্যতিরেকে পশুত্বকে লালন করার যেমন কোন সুযোগ নেই, তেমনি নেই এর স্বীকৃতিও। তাই পশু-পাখি ব্যতীত মানুষের বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ক কোন ধর্ম ও সমাজেই আজ পর্যন্ত স্বীকৃত হয়নি। তথাপিও পতিতাবৃত্তির মত এই বিষবৃক্ষটি আধুনিক নানা ছদ্মাবরণে শাখা-প্রশাখায় যেন বেড়েই চলেছে। আর আমাদের মত দরিদ্র ও অনুন্নত সমাজে পেশাটি দেশ-জাতি এমনকি সরকারের জন্যও মারাত্মক বিব্রতকর এবং ক্যান্সারসমতুল্য।

এ পেশা সামাজিক ও স্বাভাবিকভাবে ভদ্র নারীদের জন্যও কম মান-মর্যাদাহানীকর এবং লজ্জাষ্কর নয়। তাই কেউই চায়না এমন জীবন ও স্বাস্থ্যহানীকর মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ নোংরা পেশা সমাজে জিইয়ে থাকুক। কোন পুরুষই তার নিজের মা-বোন বা সন্তানদের এ পেশায় নিয়োজিত করার কথা কল্পনা না করলেও কিছু বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন পুরুষ এখনো কিন্তু এ পেশার পক্ষে বেশ সোচ্চার, যা বিষ্ময়কর বৈকি? ইসলামধর্ম তাই এধরণের মানবেতর জীবনে নিপতিত নারী ও শিশুদের চায় সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন এবং সামাজিক পুনর্বাসন। 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদও দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর নারী ও শিশুদের মানবেতর জীবন-যাপনের হাত থেকে উদ্ধারের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে এগিয়ে আসায় জাতি আশার আলো দেখছে।  রাজবাড়ি জেলার দৌলতদিয়া যৌনপল্লিটি দেশের বৃহত্তম একটি যৌনপল্লী, যা ঐ এলাকার জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। শিশু, কিশোরী, মাঝবয়সী ও বৃদ্ধাসহ কয়েক হাজার যৌনকর্মীর বাস এখানে। বিশেষত এখানকার অসামাজিক ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশে বেড়ে উঠছে শত শত নিস্পাপ শিশু এবং বাড়ন্ত কিশোরীদেরও বাধ্য করা হচ্ছে পতিতাবৃত্তিতে।

এমনকি যৌনপেশায় উপযুক্তকরণের জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের পশু মোটা-তাজাকরণ বড়ি খাইয়ে হলেও ঠেলে দেয়া হচ্ছে এ নোংরা পেশায়! পশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এসব ট্যাবলেট মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এসব বড়ি ক্যান্সারসহ জীবনঝুঁকি দ্রুত বাড়ায়, যা দেশের স্বাস্থ্যসমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে। অথচ এদিকে নজর দেয়ার কেউ নেই। এখানে কারুর জন্য নেই কোন স্বাস্থ্যসেবা। মাদক, সন্ত্রাসসহ নানা দুর্নীতির সাথে জড়িত দেশ-জাতির জন্য ক্ষতিকর দালালশ্রেণী, দাগী আসামী ও সন্ত্রীদের অভয়ারণ্যও হচ্ছে এই যৌনপল্লীটি।

শুধু তাই নয়, যৌনযন্ত্র ও পণ্যসেজে দেহবিক্রির মত অমানবিক কার্যক্রমে লিপ্ত নারী-শিশুদের আয়ের সিংহভাগও লুটেপুটে খায় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারীবাহিনীর কিছু বিভ্রান্ত সদস্যসহ বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীরা। ফলে যথেষ্ট আয় করেও অনেক সময় তাদের উপযুক্ত খাদ্য-বস্ত্রসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। রাজবাড়িসহ দেশের আর্থ-সামাজিকক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ, স্বাস্থ্য ও আইন-শৃঙ্খলার জন্য হুমকিসত্ত্বেও স্বাধীনতার চারদশক পরেও এ সমস্ত হতভাগ্য নারী-শিশুদের উদ্ধারের জন্য কার্যকরী কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য চরম অবমানকর।

সুতরাং ২০১১ সালের শুরুতে আশা করি সরকারী-বেসরকারী সংস্থাসমূহ এদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসবে। ইসলামী দলগুলোরও ভূমিকা এ ব্যাপারে নেই বললেই চলে, যা হতাশাব্যঞ্জক। বিদেশী অর্থায়নে কিছু কিছু এনজিও এদের নিয়ে কাজ করে ঠিকই কিন্তু তা এদের স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য নয়। বরং অন্যান্য বৈধ শ্রমজীবীদের কাতারে ফেলেই ‘যৌনকর্মী  হিসেবে এদের জীবন- মানোন্নয়নের লক্ষ্যেই তারা যা কিছু করার করে থাকে। কিন্তু ইসলাম যেহেতু মানুষকে শ্রেষ্ঠজীব হিসেবে দেখে এবং পরকালে পাপ-পুণ্যের হিসেবের কথা বলে, সেক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলো এদের দায়-দায়িত্ব কোনক্রমেই এড়িয়ে যেতে পারে না। তাদের এধরণের নিশ্চুপ ভুমিকার ব্যাপারে যে প্রশ্নও ওঠেনা, তা কিন্তু নয়? তাই স্থায়ী পুনর্বাসনের  ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এদের মৌলিক মানবাধিকার পূরণের লক্ষ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
ক. দৌলতদিয়া যৌনপল্লী নিয়ে কর্মরত বেসরকারী সংস্থার সহায়তায় সরকার কর্তৃক ঐ নোংরা পল্লীর নিষ্পাপ শিশুদের অবিলম্বে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। 
খ. যৌনপল্লীতে বাড়ন্ত কিশোরী এবং পাচার হয়ে আসা কিশোরীদের উদ্ধারের জন্য জেলাপ্রশাসনের মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারী সংস্থার সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। অতপর কমিটির নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় অনির্ধারিত ঝটিকা অভিযান চালিয়ে কিশোরীদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে।
গ. দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালাল ও বাড়িওয়ালীদের মাধ্যমে পাচারকৃত কিশোরী এবং নারীরা যাতে পুনরায় যৌনপেশায় যুক্ত হতে না পারে, সংশ্লিষ্ট এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তা নিশ্চিত  করতে হবে।
ঘ. অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীদের কথিত এফিডেভিট করার ক্ষেত্রে নোটারি পাবলিক বা সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেটদের সহযোগিতাবন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
ঙ. পুলিশি অভিযানে ধৃত কিশোরীরা নিরাপত্তা হেফাজত থেকে আবার যাতে আদালত হয়ে দেহব্যবসায়ীদের খপ্পরে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।
চ. যৌনপল্লীর নারী-শিশুদের পুনর্বাসনে বাধ্যতামূলক এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি  ভাসমান পতিতাবৃত্তিসহ সকল পতিতাবৃত্তি বন্ধ করতে হবে।
ছ. পুরুষ বিশেষত ছাত্র ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের বহুগামিতাবন্ধে সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
জ. পুনর্বাসিত না হওয়া পর্যন্ত যৌনপল্লীর নারীদের ওপর সকলপ্রকার নির্যাতনবন্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
ঝ. রাজবাড়ি থেকে প্রকাশিত RCN এবং সরকারী-সেরকারী  ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টমিডিয়ার মাধ্যমে পতিতাবৃত্তির ভয়ঙ্কর দিকগুলো প্রচারের দ্বারা সামাজিক গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ঞ. সমাজকল্যাণমন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারী-বেসরকারী এনজিও/প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যৌনপল্লীর নারীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে এনজিও/প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসার কাজে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহ যোগাতে হবে।