30.5.11


অপরাধ দমনে সরকারের অঙ্গীকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
শাহ আলম বাদশা

            ৭৩ বছরের বৃদ্ধা রহিমনের মনে সুখের বাতাস। তাঁর কলেজ পড়ুয়া নাতি শহর থেকে এসে তাঁকে বলে গেল, রাজাকারদের বিচার হবে। ’৭১ সালে দেশে টান টান যুদ্ধাবস্থা। একদিকে পাক-হানাদার অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা। এরই মধ্যে চামচিকা রাজাকার। একদিন রাজাকাররা এসে ধরে নিয়ে গেল তার স্বামীকে। অপরাধ ছেলে বাড়ীতে থাকে না, অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা। চোখের সামনে মেরে ফেলল তাঁর স্বামী জমিরউদ্দিনকে। যুদ্ধে মারা গেছে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা ছেলে। সে একেবারে খুদে ৭ বছর বয়সী মুক্তিকে বুকে আগলিয়ে বড় করেছে। কিন্তু রাজাকারদের বীভৎস নৃশংস হত্যাকান্ড ভুলতে পারেনি। সেই রাজাকারদের বিচার হয়নি। বরং সেই রাজাকাররা স্বাধীনতার পর দেশের ক্ষমতাবান বিত্তবান হয়েছে। দুঃখে ক্ষোভে লজ্জায়, মরে যেত রহিমন। প্রতিদিন আল­াহুর কাছে দোয়া করত, সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। রহিমন ডুকরে ডুকরে কাঁদে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে, এ অধ্যায়ের অবসান বুঝি হবে, এবার। আল­াহ তাঁর দোয়া কবুল করেছে। রাজাকারদের বিচার হবে। তাঁর স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার হবে।            

বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল অপরাধদমন এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তাই দেশের অপরাধদমন ও অপরাধীদের কার্যকরভাবে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে বেশকিছু নতুন আইন প্রণীত হয়েছে। যেমন- জনগণকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে চাঁদবাজী, যানবাহনের ক্ষতিসাধন অথবা গতিরোধ, সরকার বা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বিনষ্ট, ছিনতাই, জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, টেন্ডারবাজী, অর্থআদায় ইত্যাদি দমনে ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন’’। সারাদেশে ৭৬টি আদালতের মাধ্যমে কার্যকরভাবে সংশি­ষ্ট অপরাধের বিচার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদন্ড ও অর্থদন্ড দেয়া হয়ে থাকে।

হত্যা, ধর্ষণ, আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য এবং মাদকদ্রব্যসংক্রামত্ম অপরাধদমনে প্রণীত হয়েছে- ‘‘দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল আইন’’। সারাদেশে ৯টি ট্রাইবুন্যালের মাধ্যমে বিচার কার্য চলছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাসিত্ম হচ্ছে মৃত্যদন্ড। তাছাড়া ‘‘এসিড অপরাধদমন আইন-’’ প্রণয়নের মাধ্যমে এসিডের অপব্যবহারকারীদের পূর্বের তুলনায় অধিকতর কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে। এমনকি ৩টি নতুন আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমান ৫টি আইন সংশোধনের ফলে অপরাধদমন এবং অপরাধীদের শাসিত্মবিধানে অনুকুল অবকাঠামো প্রস্ত্তত হয়েছে।

প্রচলিত বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার, বিচারের সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ, পদ্ধতিগত জটিলতা সহজীকরণ এবং বিচারপ্রক্রিয়া ব্যয়হ্রাসের মাধ্যমে সামগ্রিক বিচারব্যবস্থার দক্ষতাবৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের দেওয়ানী কার্যবিধি সংশোধন, ফৌজদারী আইন সংশোধন ও অর্থঋণ আদালত আইন নতুনভাবে প্রণীত হয়েছে। অবৈধ পন্থায় অর্থহসত্মামত্মর, রূপামত্মর, অবস্থান, গোপনকরা, পাচারপ্রতিরোধ ও শাসিত্মবিধানের লক্ষ্যে ‘‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন’’ প্রণয়ন করা হয়েছে।

আইন প্রণয়নের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর মামলাসমূহ নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা ও পারবীক্ষণের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় পর্যায়ে ১০ সদস্যবিশিষ্ট মনিটরিং সেলে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এমনকি মামলা আদালতে উপস্থাপনের পূর্বে তদমত্ম রির্পোটসমূহের টেকনিক্যাল ত্রুটি-বিচ্যুতি পর্যালোচনা করা হয়।  অনুরূপভাবে দেশের ৬৪টি জেলায় জেলাপ্রশাসকের নেতৃত্বে এবং ৬ বিভাগে বিভাগীয় কমিশনারদের নেতৃত্বে মনিটরিং সেলেও নিবিড় পর্যালোচনা হচ্ছে। এতে মামলা নিষ্পতিতে বিলম্ব দূর হচ্ছে এবং বেশির ভাগ মামলা শাসিত্মর মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নিষ্পত্তিকৃত মামলাগুলোর মধ্যে উলে­খযোগ্য হচ্ছে -গাইবান্ধার তৃষা হত্যা মামলা, ঢাকায় শিহাব, জুয়েল, শিশু নওশীন, শাজনীন হত্যা মামলা।

                         
এসিডসংক্রামত্ম ২টি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে যেমন‘‘জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল’’ রয়েছে তেমনি জেলায় জেলায় ‘‘জেলা এসিড নিয়ন্ত্রণ কমিটি’’ কার্যকর রয়েছে। এছাড়াও ‘‘এসিড নিয়ন্ত্রণ (তহবিল) বিধিমালা’’ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এসিডের ব্যবহার, উৎপাদন ইত্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য ‘‘এসিড আমদানী, উৎপাদন, মওজুদ, পরিবহন, বিক্রয় ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা’’ প্রণয়ন করা হয়েছে।

বিশেষতঃ নারী ও শিশু পাচাররোধে বিচারাধীন মামলায় অগ্রগতি এবং এ সংক্রামত্ম বিভিন্ন কার্যক্রম মনিটরের উদ্দেশ্যে স্বারাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে আমত্মঃমন্ত্রণালয় কমিটি কার্যকর রয়েছে। নারী ও শিশু পাচারসংক্রামত্ম ২০টি সুনিদিষ্ট মামলা নিবিড়ভাবে মনিটর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের যুগ্নসচিব (আনসার, উন্নয়ন ও সীমামত্ম) এর নেতৃত্বে আমত্মঃমন্ত্রণালয় কমিটি কাজ করছে। পুলিশ সদরদপ্তরে নারী ও শিশু পাচাররোধে একটি সেল গঠিত হয়েছে। উক্ত সেল নারী ও শিশু পাচারসংক্রামত্ম মামলা এবং ভিকটিম উদ্ধার ও পূর্ণবাসন সংক্রামত্ম বিষয়াদি নিয়মিত মনিটর করছে। নারী ও শিশু পাচারসম্পর্কিত মামলাসমুহ আরো গুরুত্বসহকারে পরিচালনার জন্য জাতীয় পর্যায়ে একজন সহকারী এর্টনি জেনারেল এবং প্রতি জেলায় একজন করে পিপিকে সুনিদির্ষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে প্রতিজেলায় মানবপাচার বিশেষতঃ নারী ও শিশু পাচাররোধকল্পে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। ভূয়া জাল পাসপোর্ট ও ভিসা ব্যবহার এবং মানবপাচার রোধকল্পে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্নসচিবকে(আনসার, উন্নয়ন ও সীমামত্ম) আহবায়ক করে একটি আমত্মঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অপরাধদমন এবং আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়নে পুলিশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি ১৩৫০ জন লোকের জন্য রয়েছে মাত্র ১ জন পুলিশ সদস্য, যেখানে ভারতে প্রতি ৭২৮ জনের ১ জন ও পাকিসত্মানে প্রতি ৬২৫ জনে ১ জন পুলিশ রয়েছে। সরকার তাই পুলিশের জনবলবৃদ্ধির বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে ১৩০৭৭টি নতুন পদসৃজন করা হয়েছে। তাছাড়া কারাগারের অপরাধীদের সংশোধনের পাশাপাশি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সারাদেশে বন্দী ধারণক্ষমতা ২৪,৫১২ জন থেকে ২৫,৭১২ জনে উন্নীত করা হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার চালুও একটি ব্যাতিক্রমী পদক্ষেপ। দেশের ৪টি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেসিতে ৩৯ জন বিচারকের মাধ্যমে ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থাও চালু রয়েছে। দূর্নীতিদমনের ক্ষেত্রে সরকারের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার বাসত্মবায়নের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে বহুল আলোচিত ‘‘স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন আইন’’ এবং সরকার ইতোমধ্যে স্বাধীন দুর্নীতিদমন কমিশনও গঠন করেছে, যা দুর্নীতিদমনে যথেষ্ট ভূমিকা  রাখছে।

বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতোমধ্যে ১৯৭৩ সালের ‘‘আমর্ত্মজাতিক অপরাধ (ট্রাইবুন্যাল) অ্যাক্ট’’ এর আওতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রসিকিউটর দপ্তর স্থাপন করা হয়েছে। দেশবাসীর সমর্থন ও আমর্ত্মজাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকার। তাছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং জেলখানায় চারনেতা হত্যার বিচার কার্য সম্পন্ন করার বিষয়কেও সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।