কৃষিকাজে নারী ও নারীশ্রমিক
শাহ আলম বাদশা
সোনেকা বালার বয়স এখন প্রায় ৫৫বছর। তিনি ২০বছর ধরে মজুরির ভিত্তিতে কৃষিকাজের কামলা বা শ্রমিক হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করে যাচ্ছেন। বিরাট সংসারের বোঝা সামলাতে তার স্বামী যেমন অন্যের জমিতে মজুর খাঁটছেন, তেমনি তিনিও বাধ্য হয়েছেন এপথ বেছে নিতে। নারী হিসেবে কাজটি অত্যন্ত কঠিন হলেও ১০/১২ জন নারীসঙ্গীর সাথে দীর্ঘদিন যাবৎ করতে করতে বর্তমানে গা সয়ে গেছে তার। কাদাজমিতে ধানের রোয়া লাগানো, বীজতলা থেকে ধানের বীজ উঠানো, পাকাধান ও গমকাটা, ধান ও গমের আঁটি মাথায় করে মালিকের বাড়িতে পৌঁছানো ইত্যাদি সবই করে থাকেন তিনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দৈনিক মজুরির বিনিময়ে কিংবা চুক্তি বা ঠিকার ভিত্তিতে সদলবলে শুধুমাত্র কৃষিকাজেই কামলা দিয়ে থাকেন। কেননা অন্যকাজে তিনি আদৌ অভ্যস্ত নন। একসময় তারও কিছু জমিজমা ছিলো এবং আরও ধানীজমি বন্ধক নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে মিলে চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন। কিন্তু সে দিন আর নেই বলে এখন তারা মজুর খাঁটেন অন্যের জমিতে। এভাবেই শতকষ্টের মাঝেও তিনি পাঁচ ছেলেমেয়ের বিয়ে পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছেন। শরীর না চললেও আরও দু‘জন নাবালক ছেলেমেয়ের স্বার্থে এখনও নিরলস খেঁটে চলেছেন তিনি। কিন্তু জানেন না, কবে হবে তার জীবনের অবসর?
আজকাল বাংলাদেশের গ্রাম-শহর সর্বই এধরণের অসংখ্য নারীশ্রমিকের দেখা পাওয়া যায়। অবশ্য কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ নতুন কোনো বিষয় না হলেও গামেন্টস্ কর্মী, দালানশ্রমিক, মাটিকাটাশ্রমিক, রাস্তনির্মাণশ্রমিক, গৃহস্থালীশ্রমিক(কাজের বুয়া) হিসেবে নারীদের সংঘবদ্ধ শ্রমবিকানোর কাজ কিন্তু খুব বেশিদিনের পুরনো নয়। তবে যা-ই হোক না কেনো, নর-নারীর সম্মিলিত প্রয়াসের ফলেই যে পৃথিবী আজ এতদূর এগিয়েছে, একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। যুগযুগ ধরে নারীরা নেপথ্যে বা অন্তরালে থেকেই পুরুষের যাবতীয় কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন, একথা কৃতজ্ঞ পুরুষমাত্রই স্বীকার করবেন। নারীরা এখন নিজ ক্ষমতাবলে পুরুষের পাশাপাশি সর্বনিম্নপর্যায় থেকে শুরু করে ক্ষমতার সর্বোচ্চশিখরে পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। আধুনিকবিশ্বে নারীর অবদান আজ কোনোক্রমেই উপেক্ষনীয় নয়। তাই কবি নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন-‘বিশ্বের যা কিছু মহান চিরকল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ এদেশের কৃষিউন্নয়ন তথা কৃষিক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা তাই অতুলনীয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই কৃষক। ইতিহ্যগতভাবে কৃষিজীবী পুরুষদের পাশাপাশি এদেশের গৃহিণী-নারীরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরাসরি অবদান রেখে চলেছেন। ফলে মান্ধাতা আমলের চাষাবাদপদ্ধতির বদলে অত্যাধুনিক পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও উপয়-উপকরণের সমন্বয়ে শস্যোৎপাদন পচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশও আজ খাদ্যোৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য গৌরবের বৈকি? এদেশের কৃষিউৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ার সাথেই গ্রামীণ নারীরা নানাভাবে সম্পৃক্ত। গ্রামের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে, ধান,পাট, গম, তিল-তিসি,আখ, ভূট্টাসহ অন্যান্য ফসলাদি বোনা থেকে শুরু করে ঘরে তোলার কাজেও নারীরা এখন শ্রমের বিনিময়ে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ এই সেদিনও এদেশের নারীগণ অসূর্যস্পর্শা বা অবরোধবাসিনী হয়ে অন্দরমহলেই থাকতে বাধ্য হয়েছেন এবং তাদের দ্বারা এধরণের কাজের কথা কল্পনাও করা যেতো না। আজ দিন পাল্টেছে, কিষান-কিষাণী ও পুরুষ কামলা বা শ্রমিকের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে গড়ে উঠেছে একদল নারীশ্রমিকও। নারীশ্রমিকরা এখন পুরুষদের মতোই বীজতলার চারাত্তোলন, শস্যবপন ও রোপন, আগাছানিড়ানী, শস্যকাটা, শস্যমাড়াই এমনকি শস্য গোলায় তোলার ন্যায় কষ্টসাধ্য কাজটিও করতে পিছপা হচ্ছেন না। কৃষিজীবী পরিবারের কিষাণী ও গৃহিণীদের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথাও কেইবা না জানে? গ্রামীণ কিষাণীরা সাধারণত তরিতরকারী আবাদ থেকে শুরু করে যাবতীয় কৃষিবীজ সংরক্ষণ, ধানসিদ্ধকরণ ও শুকানো, সর্বপ্রকার ফসলমাড়াই, গোলায় শস্যতোলা, ধানকে চালে রূপান্তরকরণ, মুড়ি ও চিড়া তৈরিকরণ, গরু-ছাগলপালন ও মাঠে চরানো, গেবরসহ নানারকম জৈবসার তৈরি, শ্রমিক কামলাদের জন্য রান্নাবান্নাকরণ ও তাদের খাদ্যপরিবেশন, কৃষিক্ষেতের কাজ দেখাশোনাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি কাজই করে থাকেন।
এতা গেলো একদিক, অন্যদিকে এদেশের বেশকিছু নারী কঠোর সাধনা ও সংকল্পে অটল থেকে নগণ্য পুঁজি কিংবা সামান্য কৃষিঋণের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে দূর্লভ নজিরস্থাপন করেছেন এমনকি কেউকেউ লাখোপতি পর্যন্ত বনে গেছেন। সরকারি-বেসরকারিপর্যায়ে কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের পুরুস্কৃত হবার সংবাদ পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং শ্রমবাজারে নারীরা আজ আর অবহেলা ও অবমূল্যায়নের পাত্র নন, প্রয়োজন শুধু তাদের শ্রমের যথাযথ মূল্যায়নের।
তবে এ কথা ঠিক যে, এদেশের নারীশ্রমিক যারা কলে-কারখানায়, বাসা-বাড়িতে ও ক্ষেতে-খামারে অত্যন্ত দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথেই কাজ করে থাকেন, অনেকক্ষেত্রেই তাদের উপযুক্ত সম্মানী বা ন্যায্যমজুরি দেয়া হয়না, যা নেহায়েত অন্যায়! তারাও পুরুষদের ন্যায় সমান কাজ করেও মজুরির বেলায় কম পাবেন কেনো, এটা বোধগম্য নয়। নারীদের এভাবে অবমূল্যায়ন করার অর্থ আমাদের নিজেদেরই ছোট করা এবং সংশ্লিষ্টদের এটা চরম হীনমন্যতা বৈ আর কিছু নয়। তাছাড়া নারীশ্রমিকরা সাধারণত পুরুষদের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী ও নিরলস এবং ফাঁকিবাজীতেও অভ্যস্ত নন। এমনকি দেখা যায় যে, অসহায়ত্বের কারণে সস্তায়ই তাদের শ্রম কেনা যায় বলে তাদের প্রতি নিয়োগকর্তাদের আগ্রহও থাকে বেশি। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের এটা একটা নিকৃষ্টতম উদাহরণও বটে। অথচ নবী(সাঃ) ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেস্ত’ বলে মাতৃজাতি হিসেবে নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদাই দিয়েছেন। এটাও অস্বীকার করবার জো নেই যে, কর্মজীবী নারীদের অনেকক্ষেত্রেই পুরুষদের চাইতে বেশি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডবল কাজও করতে হয়। কেননা নারীদের ঘরসামলানোর পর গর্ভধারণ, সন্তানপ্রতিপালন ইত্যাদির সাথেসাথে চাকরি করে অর্থোপার্জন করাটা সত্যিই অনেক কঠিন কাজ! অথচ অনেক পুরুষই এ সত্যটা উপলদ্ধি করতে চান না বা এধরণের চাকরিজীবী নারীদের যথাযথ মূল্যায়নও করেন না।
সুতরাং নারীজাতিকে অবহেলা করে বা উন্নয়নসহযোগী হিসেবে তাদের দূরে ঠেলে রাখলে, কখনোই আমরা প্রকৃত অগ্রগতিলাভ করতে সক্ষম হবো না। তাই সর্বাগ্রে নারীদের প্রতি পুরুষদের অবমূল্যায়ন ও বৈষম্যমূলক মন-মানসিকতারই পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অতপর নারীকে শুধুমাত্র একজন নারী হিসেবে না দেখে সর্বক্ষেত্রে তার কর্ম এবং মর্যাদার ভিত্তিতেই তাকে মূল্যায়ন করতে হবে। সাধারণত সরকারিপর্যায়ে কর্মজীবী নারীদের এধরণের সমস্যা না হলেও কল-কারখানায় ও বসা-বাড়িতে কর্মরত কাজের বুয়া এবং দৈনিক কিংবা মাসিকভিত্তিক নারীশ্রমিকদের বেলায়ই বেতন ও মজুরির বৈষম্য ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা মালিকদেরই উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উন্নত মানসিকতার পরিচয় দিলেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। পাশাপাশি এ সমস্যার সমাধানে সরকারি কড়া নজরদারীরও প্রয়োজন আছে।
*******