30.5.11


আমিষের চাহিদাপূরণে সরকারী মৎস্যপ্রকল্পসমূহ 
শাহ আলম বাদশা

          ছালেহার অপুষ্ট শরীর এমনিতেই চলেনা, বুকের দুধ পর্যমত্ম গেছে শুকিয়ে। এমনকি একবছর বয়সী ছেলেটির শরীরও পুষ্টিহীনতায় কংকালসার হয়ে গেছে। আসলে গরীবঘরের সমত্মান ছালেহার বাল্যবিবাহই ওর কাল হয়েছে। বাবার সংসারে এমনিতেই মাসে একদিন মাছ-গোস্তের দেখা পায়নি ; তারপর ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে দীনহীন এক ঠেলাওয়ালার সাথে। এখানে এসেও সে খুব একটা মাছ-মাংসের স্বাদ পায়নি। বছর না যেতেই আবার গর্ভে এসেছে অপুষ্ট একশিশু। কচু-গেঁচু খেয়ে আর যাহোক আমিষের চাহিদাতো পূরণ হওয়া সম্ভব নয়? তাই দেহগঠন, পুষ্টিসাধন, দেহের বলশক্তি, রোগপ্রতিরোধ শক্তি মা-ছেলের কারোর ভাগ্যে ভর করতে পারেনি। এখন তাই মরণদশা আর কি? ফলে ডাক্তার মা ও ছেলের জন্য ঔষধ, পথ্য এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের যে তালিকা দিয়েছে তাতেই মাথা খারাপের যোগাড় ওর স্বামীর। এ ধরণের ঘটনা বাংলার ঘরে ঘরে এখন অহরহ দেখতে পাওয়া যায়। আমিষের অভাবে কত ছালেহার জীবনই না ঝরে যাচ্ছে, তার কি ইয়াত্তা আছে?

            এসব কারণেই দেশীয় প্রোটিনের চাহিদাপূরণ এবং আত্ননির্ভরশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে ইলিশের জাটকানিধন প্রতিরোধ ও দেশীয় প্রজাতির বৈচিত্ররক্ষার জন্য সরকারিভাবে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি জলমহল ও প­াবনভূমিসমূহ সমাজভিত্তিক মৎস্যব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয়েছে। মৎস্যজীবীদের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

            কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্যসেক্টরের অবদান যেমন অত্যমত্ম গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় তেমনি জাতীয় আয়ের ৫.১৫% মৎস্যখাতের অবদান এবং কৃষি আয়ের ২৩% আসে মৎস্যখাত থেকে। তাই সরকার মাছের উৎপাদনবৃদ্ধির জন্য ‘‘বিল নার্সারি কর্মসূচির’’ আওতায় মুক্তজলাশয়ে ব্যপাক পোনাঅবমুক্তির কাজ হাতে নিয়েছে। একই সাথে জোরদার করা হচ্ছে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যমত্ম সকলসত্মরে মৎস্যজাত পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা।

            দেশের মাছের মোট উৎপাদনের ৮০% আসে অভ্যমত্মরীণ জলাশয় থেকে এবং সামুদ্রিক জলাশয় থেকে আসে মাত্র ২০%। জলাশয়সমূহে মৎস্য উৎপাদনবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে ইতোমধ্যে ৬৪ জেলার ১৮০৫টি জলমহাল ও বর্ষাপ­াবিত ধানক্ষেতে প্রায় দেড়কোটি বিভিন্ন প্রজাতি পোনামাছ অবমুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে গতবছর ৭০৬২ মেট্রিক টন মাছ অতিরিক্ত উৎপাদিত হয়েছে। এছাড়াও দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য ২৫০টি মৎস্য অভয়াশ্রম ও ইলিশের জন্য ৪টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ উলে­খযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

            উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ইজারাকৃত বিভিন্ন চিংড়ি খামার থেকে বিগত ২০০৫-২০০৬, ২০০৬-২০০৭, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরের সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে তিনকোটি টাকার অধিক। বাগদা চিংড়ির হ্যাচারিসমূহ তাদের মানোন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সকল চিংড়িখামারের চাহিদা মিটাতে সক্ষম হয়েছে। তাই সামুদ্রিক চিংড়িসম্পদকে ও তার মজুদকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক উৎস হতে
চিংড়িপোনা আহরণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে সামুদ্রিক মাছ ও  চিংড়ির মজুদ বৃদ্ধি পাবে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত হবে।

            মৎস্যখাতের উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা নিরসন এবং অনুকূল পরিবেশসৃষ্টির লক্ষ্যে পুষ্টিসমস্যা নিরসন, কর্মসংস্থানসৃষ্টি, দারিদ্রবিমোচন ও বৈদেশিক মুর্দ্রাজনের সম্ভাবনা ও অবদানের গুরুত্ব উপলব্দি করে মৎস্য আইন ১৯৫০ সংশোধন করে (Protection and convervation of fish amendment Act) জারী করা হয়। এ আইনের ২(১) ধারায় সকল প্রকার কারেন্ট জাল আমদানি, উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে শাসিত্মর বিধান রাখা হয়েছে।

            সারাদেশের আমিষের চাহিদাপূরণের লক্ষ্যে সরকার সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপকভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সরকারী এডিপিভুক্ত বাসত্মবায়িত ও বাসত্মবায়নাধীন মৎস্যপ্রকল্পসমূহের মধ্যে উলে­খযোগ্য হচ্ছে -পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় মৎস্যচাষ সম্প্রসারণপ্রকল্প, বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় মৎস্যচাষ সম্প্রসারণপ্রকল্প, গলদা চিংড়িহ্যাচারি উন্নয়ন ও চাষপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প, বাগদাচিংড়ি চাষপ্রযুক্তি সম্প্রসারণপ্রকল্প, মৎস্যচাষ উন্নয়নপ্রকল্প ইফাদ, নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলাধীন জবই বিলে মৎস্যচাষ উন্নয়নপ্রকল্প, সমন্বিত মৎস্যকার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্রবিমোচন প্রকল্প-২য় ধাপ, নতুন জলমহাল নীতিমালা উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্যচাষ উন্নয়নপ্রকল্প, ময়মনসিংহ মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প-কনসোলিডেশন ফেইজ, উপজেলা পর্যায়ে মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প ২য় পর্যায়, পাবর্ত্যচট্টগ্রামের পাহাড়ি জলাশয়ে মৎস্যচাষ সম্প্রসারণপ্রকল্প, ব্রুডব্যাংক স্থাপনপ্রকল্প, দেশের পশ্চিমাঞ্চলে ছড়া ও বিলে মৎস্যচাষ উন্নয়নপ্রকল্প, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প-৩য় পর্যায় ম্যাচ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিনিয়োগ সহায়তা প্রকল্প, এম্পাওয়ারমেন্ট অব কোস্টাল ফিশিং কমিউনিটি ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প-২য় পর্যায়, রিসার্চ ফল সাসটেইনেবল এ্যাকুয়া কালচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, পলিসি এন্ড প­ানিং সার্পোট ইউনিট, চিংড়িচাষ উন্নতকরণ কার্যক্রম, মৎস্যপণ্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ জোরদারকরণ প্রকল্প, ডেভেলপিং ন্যাশনাল শ্রিম্প সীড সার্টিফিকেশন সিস্টেম, অভ্যমত্মরীণ মুক্তজলাশয়ে মৎস্য আবাসস্থল পুনরুদ্ধারপ্রকল্প, ক্ষুদ্রাকায় জলাশয়ে মৎস্যসম্পদ উন্নয়নপ্রকল্প, সামুদ্রিক ক্ষুদ্র মৎস্যজীবিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নপ্রকল্প, অভ্যমত্মরীন পুকুরজলাশয়ে সমন্বিত কার্প ও স্বাদুপানির চিংড়িচাষ সম্প্রসারণপ্রকল্প, ইউনিয়নপর্যায়ে মৎস্যসেবা সম্প্রসারণপ্রকল্প, প­াবনভূমমেত মৎস্যচাষ অবকাঠামো নির্মাণপ্রকল্প, মৎস্যবিপণন অবকাঠামো নির্মাণপ্রকল্প ও মৎস্য গবেষণা কর্মসূচি জোরদারকরণ ও প্রযুক্তি হসত্মামত্মরপ্রকল্প।

            এসব প্রকল্পের সফলমেয়াদী বাসত্মবায়ন সম্ভব হলে এক সময়ের মাছে-ভাতে বাঙালির হৃত ঐতিহ্য আবার যেমন ফিরে আসবে তেমনি মাছ রপ্তানী করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মূদ্রার্জনও এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।