11.8.11


ঈদুল ফিতর
মানবতাবোধের এক মহান শিক্ষা
শাহ আলম বাদশা

ছেলেটি পথের ধারে অঝোরে কাঁদছে। পাশ কেটে সবাই চলে যাচ্ছে যে যার কাজে অথবা নতুন জামা-কাপড় কিনে ফিরছে্বাড়িতে। কিন্তু তার দিকে কারও নজর নেই। হঠাৎ নজর আটকে গেল একজনের। তিনি থমকে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেনঃ কাঁদছো কেন, বাবা?
-আমার মা-বাবা নেই। ঈদের দিনে আমাকে নতুন কাপড় কে দেবে? তাই কাঁদছি।
-এসো আমার সঙ্গে, তোমারও নতুন পোশাক হবে-বলে তিনি তার জন্য নতুন পোশাক কিনে তবে বাড়ি ফিরলেন।
এতিমশিশুকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ডাকলেন সহধর্মিনী আয়েশা (রাঃ)কে, দেখো-কাকে নিয়ে এসেছি, সে-ও আমার মত এতিম। একে গোসল দিয়ে নতুন জামা কাপড় পরিয়ে দাও। মহানবীর (সাঃ) স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঈদের সাজে সাজিয়ে দিলেন। ছেলেটি তখন মৃত মা-বাবার শোক ভুলে আনন্দে একেবারে আত্নহারা।

ইসলামের দুটি ঈদই আসলে ত্যাগের আনন্দে অদ্বিতীয়। যদিও ঈদ শব্দের অর্থ খুশি বা আনন্দ। কিন্তু ইসলামে তার ব্যাপ্তি নির্দোষ আনন্দের মাত্রা ছাড়িয়ে সীমাহীন নয়। ঈদুল ফিতর অর্থ হচ্ছে ফিতরার ঈদ অর্থাৎ ফিতরা প্রদানের মাধ্যমে যে আনন্দ। তাই এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে পবিত্র রমযান মাস ও রোজার শিক্ষা। সেজন্যই হাদিসে নবী (সাঃ) বলেন, যারা রমযানের রোজা রাখেনা, তারা যেন ঈদের মাঠে না আসে। অর্থাৎ তাদের কোন ঈদ নেই। তাদের ঈদের আনন্দ করার কোন অধিকার নেই।

কারণ কী? আলস্নাহ একমাসব্যাপী সকলপ্রকার ইন্দ্রীয় সুখ ও পানাহার থেকে বিরত থেকে শুধুমাত্র ‘‘আলস্নাহভীতি’’ অর্জনের জন্যই রমযান মাসের রোজা বাধ্যতামুলক করেছেন। হাদীসে বলা হয়েছে- রোজা হচ্ছে যুদ্ধে আত্নরক্ষার ঢালস্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে রোজার কঠোর সাধনার মাধ্যমে সকল প্রকার মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটে এবং খারাপ অভ্যাসগুলো বিদুরীত হয়। একজন মুসলমান রোজা রেখে আরও উত্তম মুসলিমে পরিণত হবে-এটাই স্বাভাবিক। ফলে রোজার মাধ্যমে ক্ষুধার জ্বালাবোধ, অভাবী-গরীবদের দুঃখ-কষ্টবোধ, মানবতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, দুস্থদের প্রতি সহমর্মিতা, সহানুভুতি ইত্যাদি জাগ্রত হতেই হবে। এটাই রোজার মূলশিক্ষা।

একজন রোজাদার সারামাস ইন্দ্রীয় সুখ-সম্ভোগ ও পানাহার পরিহার করে যে শিক্ষা অর্জন করে, তা বাকী এগারো মাস নিজের জীবনে সমুন্নত রাখতে পারলেই সে সফল। অন্যথায় তার রোজা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। এ ব্যাপারে প্রচুর হাদীস রয়েছে। রোজার পুরস্কার তাই স্বয়ং আলস্না্হই দিবেন বলে প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন।। আর এ রোজা পালনের সফল উপসংহারের নামই হচ্ছে- পবিত্র ঈদুল ফিতর। মানে একমাসব্যাপী সাময়িক নিষিদ্ধ হালালকাজসমূহ আবারও চালু হলো এবং ঈদের আনন্দের মাধ্যমে ধুমধামের সাথেই এখন খাও, দাও এবং স্ফূর্তি করো। ঈদের কয়দিন তাই রোজা রাখা হারাম করা হয়েছে অর্থাৎ এ সময় রোজাদারদের আনন্দ-স্ফূর্তি করার জন্যই ঈদের আগমন।

কিন্তু সেই ঈদপালন যেন অমানবিক ও স্বার্থপরের মতো না হয়, তাই আলস্নাহ তায়ালা ফিতরার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছেন। মূলত গরীব-দুঃখীদের ঈদে একাত্ম করার জন্যই এ ফিতরার প্রচলন। ঈদের মাঠে যাবার আগে নিজ নিজ পরিবারের জীবিত সদস্যদের পক্ষ থেকে মাথাপিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ (চাল বা গম) অর্থ বিলিয়ে দিতে হবে গরীবদের মাঝে, যাতে তারাও নতুন কাপড় পরতে পারে, আনন্দ-ফূর্তি করতে পারে। এদেশে বর্তমানে মাথাপিছু ফিতরার পরিমাণ হচ্ছে ৪০ টাকা মাত্র। ফিতরার টাকা যেহেতু গরীব-দুঃখীদের হক, তাই টাকাটা এমনিভাবে বন্টন করা উচিৎ যাতে একটা দুঃস্থ পরিবার সত্যিই ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে। নতুবা ভিক্ষার আদলে ফিতরার টাকা জনে জনে বিলিয়ে দিলে ফিতরার পুরো উদ্দেশ্য-লক্ষ্য আসলে অর্জিত হয় না, এ বিষয়টি আমাদের ভাবা দরকার।

কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা কী দেখি। রোজা রাখুক বা না রাখুক জাঁকজমকের সাথে ঈদপালন করা চাই-ই। অথচ ঈদের আনন্দ হচ্ছে ত্যাগের মাধ্যমে নির্দোষ ও পবিত্র আনন্দ। কিন্তু আমরা কীরকম আনন্দ করি? যা রোজার শিক্ষার ধারে কাছেও যেতে পারে না। বর্তমানে ঈদের আগে-পরে গরীব দুঃখীদের তেমন একটা ভাগ্য পরিবর্তনও হয় না। যেমন এতিমশিশুটির ক্ষেত্রে তার ভাগ্যই বদলিয়ে দিয়েছিলেন নবী (সাঃ)। তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘‘ আজ থেকে তুমি এতিম নও। আমি তোমার বাবা আর আয়েশা (রাঃ) তোমার মা।’’ তাই আমরাও কি গরীব দুঃখীদের দুদর্শালাঘবে নবীর (সাঃ) অনুসরণে মা-বাবার ভূমিকায় নামতে পারি না?