23.5.11


খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি
শাহ আলম বাদশা

          খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। খাদ্যনিরাপত্তার অন্যতম শর্ত হচ্ছে পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাদ্যসরবরাহ নিশ্চিত করা, খাদ্যোৎপাদন  বৃদ্ধি করা, কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধি করা। সুতরাং কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে আভ্যন্তরীণ খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প আমাদের নেই। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% দারিদ্রে্যর কষাঘাতে বিপর্যস্ত। তন্মধ্যে প্রায় ২০% মানুষ হতদরিদ্র। দেশের এ আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে যুগোপযোগী খাদ্যনীতি প্রণয়ন, খাদ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালনা ও নির্ভরযোগ্য খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ৭৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘‘ন্যাশনাল ফুড পলিসি ক্যাপাসিটি স্ট্রেংদেনিং প্রোগা্রম’’ হাতে নিয়েছে। এ প্রোগ্রামের আওতায় ইতোমধ্যে খাদ্য নীতিমালা প্রণয়ন করে কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজসম্পন্ন করা হয়েছে। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ১১টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কর্মপরিকল্পনা পরীবিক্ষণের কাজ চলছে।

          বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়ায় প্রতিবছর বন্যা, খরা, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি কৃষি্ উৎপাদনকে করে পর্যদুসত্ম। বন্যা ও ঘুণিঝড়ের প্রতিঘাতপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ষষ্ঠ ও শীর্ষস্থানীয়। বন্যা, খরা , ঘুর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, ও তাপমাত্রাবৃদ্ধির দরম্নণ ধানোৎপাদন ৮% ও গমোৎপাদন ৩২ % কমে যেতে পারে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, চাষাযোগ্য জমিহ্রাস, জলবায়ুপরিবর্তনের বিরূপপ্রভাব এবং কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য বাংলাদেশের কৃষিকে করেছে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ফলে শস্যবিন্যাস, ফলনের জাত, চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজতকরণ পদ্ধতিও যাচ্ছে দ্রম্নত পাল্টে। এতসব কিছুর কারণে ফসল উৎপাদন হচ্ছে মারাত্নকভাবে বাধাগ্রসত্ম।

          অন্যদিকে উন্নতবিশ্বে আজ খাদ্যদ্রব্য দ্বারা অধিকহারে জৈবজ্বালানী তৈরী হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যোৎপাদন, আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং আমাদের খাদ্যআমদানী মারাত্নক ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে সারাবিশ্বে আজ খাদ্যনিরাপত্তা এক বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

          কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তাই ২৩% জিডিপি এবং ৫৭% কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদানকারী কৃষিখাতের উন্নয়নে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের ইশতেহারে কৃষি উন্নয়নের ব্যাপারটি সর্বাধিক গুরম্নত্ব পেয়েছে। কৃষিখাতকে যুগোপযোগী করতে এবং কৃষির নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাই কৃষি উন্নয়নের কৌশলগত পরিকল্পনায় সরকার বিভিন্ন যুগামত্মকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার তার রূপকল্প বা ভিশন-২০২১ অনুসারে ২০১৩ সালের মধ্যে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বদ্ধপরিকার এবং সেমতে কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাসত্মবায়নের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

          ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে খাদ্যে স্বয়সম্ভরতা অর্জনেরও বিকল্প নেই। তাই সরকার এবারের বাজেটে এখাতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৪০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। তাছাড়া এ বছর ১২ হাজার কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণের কর্মসূচীও হাতে নেয়া হয়েছে। ২০০৯ সাল পর্যমত্ম এর পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭৩.৬ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্র ছিল  নয় হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। সরকার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের স্বার্থে ও কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষিতে ভুর্তকীপ্রদান, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যোগান, কৃষি উপকরণসরবরাহ নিশ্চিতকরণ, ঘাতসহনশীল ফসলের জাতসরবরাহ সহজলভ্য করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ক্ষমতাগ্রহণের দশমাসের মাথায় তাই সারের মূল্য পরপর দু’বার কমিয়ে সর্বনিমণপর্যায়ে আনার পাশাপাশি সার বিক্রি নীতিমালাও সহজীকরণ করেছে বর্তমান সরকার।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষিতে র্ভতুকী ছিল ৪,২৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু আমর্ত্মজাতিক বাজারে ইউরিয়া ও ননইউরিয়া সারের দাম বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে ভুর্তকী ১৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে  ৫,৭৮৫ কোটি টাকায় নির্ধারণ
করা হয়। বর্তমানে আমর্ত্মজাতিক বাজারে সারের মূল্য কমে যাওয়ায় ২০০৯-১০ অর্থ বছরের জন্য কৃষি ভুর্তকীতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩,৬০০ কোটি টকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার উন্নতজাতের বীজ উৎপাদনের জন্য ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭টি কর্মসূচী এবং ৬টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সরকার এবার মজুদ ভান্ডারসমুহের বীজসংরক্ষণের ধারণক্ষমতা ৪০,০০০ মেট্রিন টন থেকে বাড়িয়ে এক লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। পাশাপাশি শস্যোৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে কৃষিগবেষণা এবং কৃষির পূর্ণবাসন চলতি বাজেটে ১৮৫.২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি গবেষণা এন্ডাউমেন্ট ফান্ডের জন্য ২০০৯-১০ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫৯৬৫ কোটি টাকা, যা দ্বারা কৃষি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

সরকারের খাদ্যবস্থাপনার লÿ্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা মজুদের ব্যবস্থা করা। দুস্থ জনগোষ্ঠীর কাছে নায্যমূল্যে খাদ্যশস্য পৌঁছে দেয়া এবং কৃষকের খাদ্যশস্যের উপযুক্ত মূল্যপ্রদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রাসায়নিক সারে পর্যাপ্ত ভুর্তকি দিয়েছে। এমনকি কৃষককে উৎপাদনে উৎসাহিত করতেও ন্যায্যমূল্যে রোরো সংগ্রহের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তাই আভ্যমত্মরীণ খাদ্যসংগ্রহের লÿ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ লক্ষ মেট্রিক টন যা বিগত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্যমজুদের পাশাপাশি বিতরণ কার্যক্রমেও উলেস্নখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দারিদ্র মানুষের ÿুধানিবারণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য টেস্ট রিলিফ (টিআর) খাতে ৪ লক্ষ মেট্রিক টন, ভিজিএফ খাতে ৫ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, ভিজিডিখাতে ২ লক্ষ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) খাতে ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার মেট্রিন টন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যও ১৪ লÿ্য মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদের চেষ্ট করা হচ্ছে।

তাছাড়া উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে অতিরিক্ত ১ লক্ষ ১০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ১৩৭টি এবং সারাদেশে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ৩৩৩টি নতুন খাদ্যগুদাম নির্মাণের পরিকল্পনা কম হয়েছে।

          আমন মৌসুমে সম্পুরক সেচসুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে বরেন্দ্র এলাকার কৃষকদের ইতোমধ্যে ১০০ ঘন্টা বিনামূল্যে সেচপ্রদান করা হয়েছে। সরকারী উদ্যোগে অধিক পরিমাণ বীজ উৎপাদন করে স্বল্পমূল্য কৃষকের নিকট পৌঁছানো হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে সেচসুবিধাবৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থবরাদ্দ, নতুন উদ্ভাবিত জাত বিশেষত প্রতিকূল আবহাওয়ায় সহনশীল জাতগুলো সম্প্রসারণ, সেচমূল্য কমিয়ে আনতে বিদ্যুৎ ও ডিজেলে ভুর্তকী প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম সরকার হাতে নিয়েছে। এমনকি কৃষি উন্নয়ন ও উৎপাদন নিশ্চিত করতে প্রতিবছরের ন্যায় সরকারীভাবে পহেলা অগ্রাহয়ণ মোতাবেক ১৫ নভেম্বর ‘জাতীয় কৃষি দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে।