23.5.11


দেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষার উন্নয়ন কার্যক্রম
শাহ আলম বাদশা
           
             বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশু রুবিনা এখন নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে আবার মায়ের সাথে মাঝে মাঝে ইট ভাঙতেও যায়। নিয়মিত উপৃবত্তির টাকা পাওয়ার দরুণ তাকে আর বেশি কাজ করতে দেয় না ওর মা । পড়াশোনায় সে বেশ মনোযোগীও হয়ে উঠেছে। তার মনে এখন-বড় হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা। আর টাকার অভাবে তাকে ঝরে পড়তে হবে না। এমনি অনেক রুবিনাই আজ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এসে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। হয়েছে বিদ্যালয়মুখী। ফলে কমে যাচ্ছে ঝরে পড়ার হার।

           বর্তমানে এদেশের শিক্ষার হার ৫১%, যা একসময় ছিল মাত্র ২৪%। শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে ‘‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ’’ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পরে ২০০৩ সালে এটিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে রূপামত্মরিত করা হয়। তখন থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষার ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যকে সুসংহত করার জন্য প্রাথমকি শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েই চলেছে।

          সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ঘাটতি দূর করার জন্য সরকার এ পর্যমত্ম ২৫,০৪২ জন সহকারী শিক্ষক ও ৩২২০ জন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে ৪,৯৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৩ সালে ‘‘প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচী-২’’ (পিইডিপি-২) চালু হয়, যা ২০০৯ সালের মধ্যে শেষ হবার কথা। এ সময় রাজস্বখাতে ৩৫,০০০ শিক্ষক নিয়োগ, ১০০০ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও ১২৮ টি উপজেলায় ১২৮টি কম্পিউটার অপারেটর পদ, ২১৬টি পিটিআই ইন্সট্রাক্টরের পদে, প্রতিটি উপজেলায় একজন করে মোট ৪৯১টি হিসাব রক্ষকের পদ, ৩৯৭টি রির্সোস সেন্টারের জন্য ৩৯৭টি ইন্সট্রাক্টর ও ৩৯৭টি সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার এবং ৩৯৭টি নৈশপ্রহরীর পদসৃষ্টি, ১৫,০০০ স্কুলে ২টি করে মোট ৩০,০০০ শ্রেণী কক্ষ নির্মাণ, ১৫০০০ অতিরিক্ত টয়লেট নির্মাণ ও নলকূপ স্থাপন করা হবে। ৮ লক্ষ জোড়া হাই ও লো বেঞ্চ এবং ১ লাখ ১২ হাজার টেবিল সরবরাহ করা হবে। ৬ বছরের মধ্যে ৩৭ কোটি ২৩ লাখ বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।

          প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-২ এর সহযোগী হিসেবে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রম নিশ্চিত করতে সরকার ২০০৪ সালে ৩৯০,৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘‘রিডিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন’’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যা শেষ হবে ২০১০ সালে। সারাদেশের ৬০টি উপজেলায় এবং শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট্রের মাধ্যমে সকল জেলাসদরে এটি বাসত্মবায়িত হচ্ছে। অধ্যয়নরত প্রথম থেকে তৃতীয়শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের মাথাপিছু ৫০ টাকা এবং ৪র্থ ও ৫মশ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের ৬০ টাকা হিসেবে অনুদান দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের বছরে ২ সেট ইউনিফরমের খরচ বাবদ ১ম থেকে তৃতীয়শ্রেণীর জন্য মাথাপিছু ২০০ টাকা এবং ৪র্থ ও ৫মশ্রেণীর জন্য মাথাপিছু ২৫০ টাকা হারে প্রদান করা হচ্ছে। ৫ম শ্রেণীর বৃত্তিপরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্যও মাথাপিছু ২০০ টাকা হারে অর্থ প্রদান করা হচ্ছে।

          নব্য সাক্ষরগণ যাতে অর্জিত সাক্ষরতা দক্ষভাবে বাসত্মবজীবনে কাজে লাগাতে পারে তারও ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহায়তায়‘‘ মানব উন্নয়নের জন্য সাক্ষরতা উত্তর ও অব্যাহত শিক্ষা’’ নামে ৩টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের যুগামত্মকারী পদক্ষেপ হচ্ছে দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রদানের প্রকল্প চালু করা। প্রকল্পের আওতায় ৬৫ হাজার ১৫টি প্রাথমিক ও স্বতন্ত্র এবতেদায়ী  মাদ্রাসা আছে এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৬০ লাখ। ‘‘হার্ড টু রিচ প্রকল্পের’’ আওতায় সরকারের নিজস্ব তহবিল ও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় ৬টি বিভাগীয় শহরে ৮-১৪ বছর বয়সী কর্মজীবি শিশুদের বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ১১,৫৫০টি শিক্ষাকেন্দ্রের মোট ৩,৩৯,১৫০ জন শিক্ষার্থীকে এ কর্মসূচির মাধ্যমে সাক্ষর করা হয়েছে। নিরক্ষরমুক্ত ৬৩০ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিশুকল্যাণ ট্রাস্টের মাসিক বৃত্তির (৪০০-৬০০ টাকা ) চেকও প্রদান করা হয়েছে। ফলে এ সকল শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক সত্মর পর্যমত্ম উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে।
                                                                                                          
‘‘হার্ড টু রিচ প্রকল্পে’’ শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ওপর ইউনিসেফ এর জরিপ থেকে জানা যায় যে, প্রাক্তন কর্মজীবি শিক্ষার্থীদের সার্বিক আয় বেড়েছে। বাল্যবিবাহ বন্ধ বা রোধ করার ন্যায় সুফলও লক্ষ্য করা গেছে। শিক্ষার্থীদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং পরিবার ও অন্যান্য সদস্যরাও তাদের মূল্যায়ন করেছে। এমনকি তাদের প্রতি নিয়োগকর্তার আচরণ ইতিবাচক হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের শিক্ষাব্যবস্থাপনা, কম্পিউটার, অন্যান্য বিষয়ে দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাহিদানুযায়ী নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ‘‘রির্সোস সেন্টার’’ স্থাপনের সিদ্ধামত্ম নেয়া হয়েছে।

          প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাবসৃষ্টি এবং মেধাবিকাশের লক্ষ্যে সরকার ৫ম শ্রেণী অধ্যয়নশেষে প্রাথমিকপর্যায়ে নির্দিষ্ট হারে মেধাভিত্তিক টেলেন্টপুল ও সাধারণ বৃত্তি প্রদান করছে।। টেলেন্ট পুলে বৃত্তির পরিমাণ মাসিক ১৬০ টাকা ও এককালীন ১০০ টাকা এবং সাধারণ বৃত্তির মাসিক হার ১০০ টাকা ও এককালীন ১০০ টাকা। সরকারের বহুমুখী কার্যক্রমের ফলে বৃত্তিপরীক্ষায় পাশের হার তাৎপর্যপূর্ণভাবে ও উলে­খযোগ্য হারে বেড়েছে। ইতিপুর্বে সারাদেশে বৃত্তির সংখ্যা ছিল টেলেন্টপুলে ৪০০০টি ও সাধারণ ১৪,৩৫০টি। সরকার এ বৃত্তির সংখ্যা বাড়িয়ে বর্তমানে টেলেন্টপুলে ২০,০০০টি এবং সাধারণ বৃত্তি ২৫,০০০টিতে উন্নীত করেছে।

          অব্যাহত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের ফলে এখন সাধারণ ও কর্মজীবি শিক্ষার্থীরা উলে­খযোগ্যহারে বিদ্যালয়মুখী হয়েছে। ঝরেপড়ার হারও কমেছে। ১৬ বছরে অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষিতের হার দাঁড়িয়েছে বর্তমানে ৫১%। সুতরাং শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। প্রবাদটির সত্যতা প্রমান করতে হলে আমাদের শিক্ষার হার শতভাগে নিয়ে আসতেই হবে। তাই সরকারের পাশাপাশি সর্বসত্মরের জনগণকে শিক্ষা আন্দোলনকে গণআন্দোলন হিসেবে  গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই।