শীতকালীন শাক-সবজি এবং মা ও শিশুর পুষ্টি
শাহ আলম বাদশা
ঋতুপরিবর্তনের সাথে সাথে এদেশে বেশকিছু রোগের পালাবদল ঘটে থাকে এবং প্রকোপ বেড়ে যায়। সাধারণত বর্ষা ও শীতমৌসুমে এ পালপবদল বেশী ঘটে। বিশেষ করে শীতমৌসুমে সর্দিকাঁশি, ভাইরাসজ্বর, এ্যাজমা, শ্বাসতন্ত্র ও টনসিলের প্রদাহ, মুখ ও জিহবার ঘা, হাত ও পাফাঁটাসহ বিভিন্ন চর্মরোগ বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এসময় গর্ভবতীরাও নানারকম খোঁস-পাচড়া ও চর্মরোগে বেশী ভোগেন। শিশুরা যেহেতু অবুঝ এবং সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল, সেক্ষেত্রে অবিভাবক বিশেষত মা-বাবাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন তাদের অসচেতনতা ও গাফলতির কারণে এসব রোগে আক্রামত্ম শিশুদের জীবন বিপন্ন হতে না পারে।
বর্তমানে দেশের ৯০% শিশু কোন না কোনভাবে পুষ্টিহীনতার শিকার। তন্মধ্যে অনুর্ধ পাঁচবছর বয়সী ৫৬% শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। ৭৫% গর্ভবতী মহিলা রক্তস্বল্পতা আক্রামত্ম। মায়ের রক্তস্বল্পতা, পরিমিতমাত্রায় খাবারের অভাব, গর্ভাবস্থায় সুষ্ঠু পরিচর্যার অভাব এবং অপুষ্টির কারণে ৫৪% শিশু স্বাভাবিকের তুলনায় কমওজন নিয়ে জন্মে, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশী। ৬ লক্ষ লোক স্নায়ুর মারাত্নক ক্রটিজনিত সমস্যায় আক্রামত্ম। তন্মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। অন্যদিকে, প্রায় সাড়ে ৮ কোটি লোক আয়োডিনের অভাবে ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে আমাদের দেশে প্রতিবছর ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু অন্ধ হয়ে যায় এবং ১০ লাখ শিশু রাতকানা রোগে আক্রামত্ম হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কাছে বাংলাদেশের শিশুদের বিভিন্ন প্রকার অপুষ্টির মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজনিত অন্ধত্ব অন্যতম স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। এজন্য কেবল দারিদ্র্যকে দায়ী করা ভুল বরং শিক্ষিত-অশিক্ষিতনির্বিশেষে ব্যাপক জনগোষ্ঠির পুষ্টিসম্পর্কে অসচেনতাই এর প্রধান কারণ। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, একটি শিশুদেহ সুস্থ রাখার জন্য দৈনিক ১৫০০ আই, ইউ, ভিটামিন ‘এ’ দরকার। ৯-১২বছরের ছেলেমেয়ের জন্য প্রতিদিন ৪৫০০ আই, ইউ এবং ১২ বছরাধিক ছেলেমেয়েদের জন্য দৈনিক ৫০০০ আই, ইউ ভিটামিন ‘এ’ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে এ পুষ্টিমাত্রা যথাযথভাবে পূরণ না হবার ফলেই শিশুদের এই দূরাবস্থা।
প্রকৃতপক্ষে, গর্ভবতী মায়ের যত্ননেয়া মানেই কিন্তু গর্ভে ধারণকৃত শিশুরই যত্ননেয়া । একজন সচেতন গর্ভবতী যদি সঠিক সময়ে ও সঠিক নিয়মে নিজের স্বাস্থ্যপরিচর্যা করেন এবং পুষ্টিসম্মত খাবারগ্রহন করেন, তাহলে অধিকাংশক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশু স্বাভাবিক ওজনসহ স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠবে। গর্ভস্থ শিশুসহ একজন গর্ভবতীর যেমন ডবল খাবার দরকার তেমনি এসময় প্রচুর পুষ্টিযুক্ত খাদ্য না খেলে মা ও গর্ভস্থ শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য। একটি শরীরের ভেতর থেকে আরেকটি জ্বলজ্যান্ত মানুষ সৃষ্টি হবার কারণে এসময়েই সাধারনতঃ মা ও শিশুর অপুষ্টি শুরম্ন হয়। পুষ্টিবিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের দেহের জন্য প্রোটিন বা আমিষ, শর্করা, স্নেহ বা চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবন ও পানি-- এ ছয়টি জরুরি পুষ্টি উপাদান দরকার। দেহের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধিসাধনের জন্য আবার ছয়টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিশেষত বাড়মত্ম শিশুদের জন্য। যেমন দেহের হাড়শক্ত হবার জন্য ভিটামিন ‘ডি’ এর খুবই প্রয়োজন আর এই ভিটামিন প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায় পালংশাকে। তাছাড়া কচুশাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, পুইশাক, কাঁচাকলাসহ যাবতীয় লৌহসমৃদ্ধ খাদ্যগ্রহনে অপুষ্টিজনিত রক্তশুন্যতা থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়।
শীতকালীন শাক-সবজির মধ্যে সহজলভ্য এবং সহজে আবাদযোগ্য লাল,সবুজ, ডাটা, পালং, বেতো ইত্যাদি শাকছাড়াও লাউ, কচু, কাচকলা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, উচ্ছে, করলা, কাকরোল, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, শশা, সীম ও বরবটির পুষ্টিগুন অধিক। আমলকি, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, আমড়া, পাতিলেবু , কাগজিলেবু, কামরাঙা, কুল, জলপাই ইত্যাদি ফলেও যথেষ্ট পরিমানে ভিটামিন সি থাকে। শীতের শাক-সবজির পচনশীলতা অনেক কম হওয়ায় সহজে তা সংরক্ষন করা যায় এবং ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ দীর্ঘসময় অক্ষুন্ন থাকে । খনিজপদার্থ ও ভিটামিনের অভাবেই
আমাদের শরীরের প্রাণশক্তি বজায় থাকেনা আর প্রতিদিনের খাবারের মধ্যেই কিন্তু এসব খনিজপদার্থ ও ভিটামিন পাওয়া যায়। একটু সচেতন ও উদ্যোগী হলে অনায়াসেই খনিজপদার্থ ও ভিটামিনসমৃদ্ধ এসব হাতের নাগালেই খাবার পাওয়া যায় । এসব আবার ধনী-গরীবনির্বিশেষে সবার ক্রয়ক্ষমতা ও সাধ্যের মধ্যেই থাকে। তাছাড়া, নিজবাড়ীর আঙ্গিনায় বা ঘরের চারপাশে কিয়ৎ পরিমান জায়গা থাকলে ভিটামিনসমৃদ্ধ শাক-সবজি এবং ফল-মূল যে কেউ সহজে ফলাতে পারে। এ ধরনের সবজির চাষ শহর ও গ্রামের গৃহিণীরা গৃহস্থালী কাজের অবসরেও করতে পারেন।
পুষ্টিহীন শিশুর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিক কারণেই কমে যায়। ফলে নানারকম রোগ তার দেহে দেখা দেয়। অপুষ্টির কারণেই শিশুরা রাতকানা, আন্ধত্ব ,চর্মরোগ, ম্যারাসম্যাস, কোয়াশিয়কর, বেরিবেরি, মুখ ও ঠোঁটের ঘা, স্কার্ভি, রক্তস্বল্পতা প্রভৃতি রোগে আক্রামত্ম হয়। অথচ দেশীয় শাক-সবজি ও কমমূল্যমানের ফলমূলগ্রহণের মাধ্যমে শিশুর সুষম খাদ্যর অভাব বা পুষ্টিহীনতা দুর করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু এ সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা এবং শাক-সবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।
অবশ্য সরকার ইউনিফের সহায়তায় নারী ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে। ব্যাপক অপুষ্টি দূর করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগে চালু করেছে পুষ্টিকেন্দ্র। এসব পুষ্টিকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে নারী-শিশু ও গর্ভবতী মায়েরা উপকৃত হয়ে থাকে। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ পুষ্টির সাথে জড়িত। শিশুরাই দেশের ভবিষ্যত কর্ণধার। এজন্যই কবি বলেছেন, ‘লুকিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ তাই একটি সুস্থ-সবল জাতিগঠনের লক্ষ্যে যেমন শিশুযত্নের কোন বিকল্প নেই তেমনি ভবিষ্যৎ কর্ণধার পেতে চাইলে শিশুদের সৎ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেও আমাদের সবাইকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।