নবজাতক ও চিরকুমারকাহিনী


শাহ আলম বাদশা

রোজকার মতোই সদ্যজাত শিশুর ন্যায় মিষ্টিরঙ ছড়িয়ে অন্ধকার মাতৃজঠর ফুঁড়ে ধীরেধীরে উঠতে থাকে সূর্য। চারদিকের সবুজ গাছ-গাছালি, বাড়িঘর আর চলমান মানুষগুলোর মুখমন্ডলে ছড়িয়ে যায় তার মোহময় লালিমা!  মানুষের শরীরে পতিত সেই গাঢ় আভা সৃষ্টি করে এক অনিন্দ্য-অনির্বচনীয় আবহ। এখন অগ্রহায়ণমাস হলেও রাত আর ভোরের দিকে কিছুটা শীতশীত লাগে। এবার হয়তো তাড়াতাড়িই নামবে শীত? ঠান্ডা আমেজে মিঠে রোদমাখা পরিবেশ কোরিয়ার মনে ভালোলাগার একটা ভাবামত্মর সৃষ্টি করে। কিন্তু কিসের শোরগোলে হঠাৎ তার সব ভাবামত্মর একেবারেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই সাত-সকালেও দেখা গেলো, তাসু মাস্টারের বাড়িসংলগ্ন গলিতে কৌতুহলী মানুষের বিরাট জটলা! বড়রাসত্মার ধারে সদরহাসপাতালের পাশেই গলিটা। কী ব্যাপার, এত ভিড় কেনো? নতুন একটা কৌতুহল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মনে। অতএব সে-ও ঢুকে পড়ে ভিড়ের ভেতর। চাক্ষুস দেখার আগেই একজন বৃদ্ধের কথায় বুঝতে বাকি থাকেনা তার, আহারে-- মাসুম ছাওয়াটার কী হইবে এ্যালা?
-ক্যানে জারুয়া ছাওয়ার যা হয়, তা-ই হইবে- আরেকজনের মমত্মব্য!
- বাবা-মা থেকেও যার কেউ নেই, তাকে জারজ বলবেন না প্লিজ --তৃতীয়জন মৃদূপ্রতিবাদ করে।
-আরে, ইয়ার দোষ কোন্টে বাহে। যামরা আকাম-কুকাম করলো, তামরাইতো আসল জারুয়া! নয়তো নাড়ীছেঁড়া ধন কাও রাসত্মাত্ ফ্যালে দ্যায়, বাবা? প্রথমজন আবারও ক্ষুব্ধপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।

          এধরণের কানাঘুষা ও বিক্ষিপ্ত মমত্মব্য শুনে কোরিয়ার নরম মনটা সমবেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। ফলে সোৎসাহে ভিড় ঠেলে দ্রুত ছুটে যায় নবজাতকের দিকে। সকালের ঠান্ডা আবহাওয়ায় অনাবৃত শিশুটি জড়সড় হয়ে থত্থরে কাঁপছে। কী ফুটফুটে চেহারা! এমন জ্যামত্ম মায়াময় ফুলকেও কেউ কফ-থুথুর মতো ছুঁড়ে ফেলতে পারে, কল্পনা করতেও কষ্ট হয় ওর। নিজে মাতৃহারা বলেই হয়তো পরিত্যক্ত ক্ষুদেমানবটির অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়। কিন্তু নিষ্পাপ শিশুটিকে নিয়ে আজেবাজে মমত্মব্যে কষ্টটা আরও বাড়ে ওর। সকালের লালিমায় ক্ষুদে শরীরটা কাশ্মীরি আপেলের রঙ ধরেছে। এমন শিশুকে মানুষমাত্রেই কোলে না নিয়ে পারেনা। অথচ লোকগুলো কী নির্দয়, একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথেসাথে ওর চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। বাচ্চাটার হাত-পা ছোঁড়া দেখে মন চায়, এক্ষুনি কোলে তুলে নেয়। কিন্তু পরক্ষণে থমকে দাঁড়ায়, সে যে অবিবাহিত? একে নিয়ে করবেইবা কী ? ভাবনার ঘূর্ণিস্রোতে কখন যে শিশুটির কাছে চলে এসেছে, টেরই পায়নি। এইযে ভাই, বাচ্চাটা নেবেন নাকি ? নিন না, আল্লাহ আপনার ভালোই করবেন---র্শীণদেহী সম্ভ^বত; অভাবগ্রসত্ম লোকটির অনুরোধে ভাবনায় ছেদ পড়ে ওর। পরমূহুর্তে সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পরমযত্নে কোলে তুলে নেয় নবজাতককে। সমত্মানের ওপর পিতৃস্নেহ কিরূপ, তা সে জানেনা। কিন্তু নবজাত শিশুটিকে পেয়েই চোখে-মুখে ফুটে ওঠে চরমানন্দের ছাপ! ভিড় ততক্ষনে আরও বাড়ে। কোরিয়া, এই  কোরিয়া--একি করছিস তুই? ক্লাশমেট প্রতিবেশি কামালের প্রশ্নে পেছন ফেরে সে-- তুই না, চিরকুমার? কে লালন-পালন করবে ওকে----
-কেনো, আমি---?
-কিন্তু তোরতো মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নেই। কিভাবে বাঁচাবি একে--কামাল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।
-ওসব বুঝিনা, আমার নজরে যখন পড়েছেই, ফেলে যেতে পারবো নারে ভাই। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা, বলেই হন্হন্ করে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে।  

ওর কান্ড দেখে কমবেশি সবাই বাহবা দিতে থাকে। দুয়েকজন বেরসিক বিরূপ মমত্মব্য করতেও ছাড়েনা- ব্যাটা আসত্মপাগল, নইলে বউ নেই-আবার বাচ্চার সখ?। একজনতো বলেই বসেন, দেখেন গিয়ে ওরই কুকর্ম কিনা। অনেক কথাই কানে যায় ওর। কিন্তু শেষের বাজে মমত্মব্যে গায়ে যেন আগুণ ধরে যায়! মন চায়, গলাটিপে মেরে ফেলে ব্যাটাকে। কিন্তু অনেক ভেবেচিমেত্ম সামলে নেয় নিজেকে। মনেমনে বলে, সবই জানো তুমি, কেনো নিলাম ছেলেটাকে। অথচ তোমার বান্দাদের মুখের কোনো লাগাম নেই, খোদা? জুম্মাপাড়া গ্রাম এখান থেকে মাইল দেড়েক পথ। বড়রাসত্মা ধরে আনমনে হাঁটে সে। লালমনিরহাট-ঢাকাগামী পরিচিত একটা বাস পাশ দিয়ে প্রচন্ড গর্জনে ছুটে গেলেই সে বুঝতে পারে, বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। ওর বাপ মরেছে শৈশবে আর মা এইচএসসি পাশের পর। দু‘ভাইবোনের অভাবী সংসারের হাল তখন তাকেই ধরতে হয়। ডিগ্রি পরীক্ষা দেয়া হয়না আর। বিবাহযোগ্য ছোটবোনের চিমত্মাতেই দিশেহারা অবস্থা। বাড়িভিটে ছাড়া কিছু রেখে যায়নি গরীব বাপ। ফলে কলেজের পাঠ চুকিয়ে নেমে পড়ে অর্থের ধান্ধায়। একসময় চাকরির আশা ছেড়ে বিদ্যুতের কাজ-কর্ম রপ্ত করে ফেলে। বিদ্যুতমিস্ত্রির কাজ করে এখন ভালোই চলে একার সংসার। বোনটির বিয়ে দেয়ার পর পাঁচবছর যাবৎ নিজেই রেঁধেবেড়ে খায় সে।


-ওটা কার ছাওয়া বাহে, কোরিয়া? জোহর আলী চাচার প্রশ্নে থমকে দাঁড়ায় হঠাৎ।
-রাসত্মাত্ পানু চাচা, কোন্ জানোয়ারের বাচ্চা জানি ফ্যালে থুইয়া গেইছে! এতক্ষণেই অবৈধ জন্মদাতাদের প্রতি জমে থাকা ক্ষোভটা ঝাড়ে সে।
          ওর বড়িতেও দ্রুত ভিড় জমে যায়। সকাল আটটা বাজে প্রায়। সূর্যের তেজবাড়ার পাশাপাশি কর্মজীবী মানুষও ছড়িয়ে পড়ে চৌদিকে। কিন্তু আজ ওর কাজে যাওয়া হয়না। নবজাতককে নিয়ে গ্রামের উৎসুক মেয়েদের মধ্যেও কাড়াকাড়ি পড়ে যায় যেন। ময়নাতো রীতিমত ছেলের মা-ই বনে যায়! কোরিয়ার হাত থেকে বাচ্চাকে একপ্রকার ছোঁ মেরে নিয়েই বাড়ির দিকে দে‘ ছুট। যেতে যেতে বলে, কোরিযা ভাই, বিয়াও না-ই করতে যখন ছাওয়ার বাপ হইনেন, যাও ছাওযার কাপড়-চোপড় কিনবার যাও।& মুই ছাওযার গাও ধুইয়া আনোং। ময়নার কথায় ভিষণ লজ্জা পায় সে। জোহর চাচার মেয়ে, বয়স ২০/২২ বছর হবে। সমত্মান হয়না, বন্ধ্যা; এই অপরাধে তিনবছর থেকে স্বামীপরিত্যাক্তা। কোরিয়ার কাছে ব্যাপারটা কক্ষনোই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বন্ধ্যাত্ব তো একপ্রকার চিকিৎসাযোগ্য রোগ, এজন্য ময়নার কী দোষ? তাই বলে চিকিৎসা না করে বছর যেতে না যেতেই তালাক দিতে হবে নাকি! ওর স্বামীরও তো একই সমস্যা থাকতে পারে, ময়নার গমণপথের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবতে থাকে সে। গরীব পরিবারের স্বামীপরিত্যাক্তা কন্যার দ্বিতীয়বিয়ে হয়তো সম্ভবপর; কিন্তু সমাজে বন্ধ্যানারীর স্বামী মেলাও কি সহজসাধ্য? খুব সুন্দরী না হলেও মেয়েটা মিশুক ও চঞ্চলা। যথেষ্ট হাসিখুশি এবং বিনয়ী স্বভাবীও। তবুও যৌতুকছাড়া স্বামী মেলেনা। ওর জন্য মাঝেমাঝে মনটা কাঁদে কোরিয়ার। তবে ওর আজকের ব্যবহারে ভিষণ চমৎকৃত হয় সে। কারণ আবেগের বশে অসহায় শিশুটিকে তুলে আনলেও বাড়িতে এসেই কিন্তু কঠিন বাসত্মবতার মুখোমুখি হয়ে যায়। মাতৃহারা নবজাত শিশুর জন্য অবিবাহিত এক যুবক কি আসলেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারে? পাড়াপড়শির নানাকথার মুখে এমন প্রশ্ন নিজেকে সে শতবার করেছে। অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, ওর একার পক্ষে একে বাঁচানো অসম্ভবপ্রায়! এসময ময়না মাতৃস্নেহে এগিয়ে আসায় আশার আলোই খুঁজে পায় সে। বিক্ষিপ্ত ভাবনার অথৈসমুদ্রে নিজেকে হারিয়ে ফেলে কোরিয়া। সহসা জোহর চাচার ডাকে চমক ভেঙ্গে যায়--কী বাহে, ছাওয়াটার কাপড় আর দুধ আনো ক্যানে?
          -ওহ্ হ্যঁা, যাই চাচা --বলে ছুটে যায় বাজারে।

আধঘন্টা পর পোশাক, লোশন, গুঁড়োদুধ ও ফিডার মিলে প্রায় পাঁচশো টাকার খরচ নিয়ে ময়নাদের বাড়িতে হাজির। ময়না গোসল করিয়ে আদর-যত্নে আরও প্রাণবমত্ম করে তোলে ছেলেশিশুটাকে। অতপর নতুন পোশাক পরিয়ে বানিয়ে ফেলে এক আদরের দুলাল! দৃশ্য দেখে কোরিয়ার মনে হয়, ও যেন ময়নারই কল্জের টুকরো। এমূহুর্তে নবজাতকের প্রতি ময়নার অপত্যস্নেহ ও আমত্মরিকতাপূর্ণ সোহাগ দেখলে মনে হবে, এ ওরই গর্ভজাত সমত্মান। কোরিয়ার অমত্মরে বিষয়টি গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আনমনে দেখতে থাকে ওর কর্মকান্ড। উঠানে বসে ময়না বাচ্চাকে নিয়ে নিদারুণ ব্যসত্ম। ওর গালে-কপালে ফুটে ওঠে বিন্দুবিন্দ ঘামের বুদ্বুদ এবং ফর্সামুখটা রোদে হয়েছে লাল! এসব দেখেশুনে আজ মনে কেমন একটা পুলক দোলা দিয়ে যায়। এতদিন পর নারীর প্রতি চরম ঘৃণাবোধের স্থলে প্রবল একটা আকর্ষণ জেগে ওঠে। মনে পড়ে কলেজজীবনের স্মৃতি! ক্লামমেট কাকলী ওকে কতই না ভালোবাসতো। রঙ্গিন স্বপ্ন দেখাতো, ঘরবাঁধার স্বপ্ন? মধ্যবিত্ত পরিবারের অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে কেন যেন ওকেই পছন্দ করে এবং ভালোবাসে, ভেবে পায়না সে। গভীর প্রণয় গড়ে উঠলেও ওদের সম্পর্কটা ছিলো মূলত: ক্যাম্পাসভিত্তিক। বেপরোয়া বা আপত্তিকর সম্পর্ক গড়ার পÿÿ কোনোমতেই সায় ছিলোনা কাকলীর। রÿণশীল পরিবারের ঐতিহ্য ভেঙ্গে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রকাশ্য মেলামেশা বা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও ছিলোনা ওর। কিন্তু কোরিয়োর মন-মানসিকতা ছিলো তার উল্টো। এ নিয়েই শুরম্ন হয় দু’জনের মতবিরোধ এবং একটা মারাত্মক ভুলেই শেষপর্যমত্ম সম্পর্কচ্ছেদে গড়ায় ব্যাপারটা! এইচএসসি দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রছাত্রী দু;জনেই। একদিন টিফিনে কোরিয়া কাঁঠালতলায় ডেকে বসায় কাকলীকে। এ-ই কাকলী, আজ এখানে কেনো বসলাম জানো?
-নাতো---? আবার কোনো কুমতলব নাকি----- কাকলী খোঁচা মারে।
-আরে নাহ, তুমি শূধু শুধু সন্দেহ করো! আচ্ছা কাকলী, তুমিতো অন্যদের মতো আমার সাথে সিনেমায় যাওনা বা ঘুরেও বেড়াও না? এমন নিরস প্রেম কেউ করে নাকি, তুমিই বলো? কোরিয়ার অভিমানী প্রশ্ন।
-অবশ্যই করে, আরে সত্যিকার ও পবিত্র প্রেমতো এমনই হয়। ভদ্রঘরের সমত্মানরা প্রেমের নামে বেলেস্নাপনা, বেপরোয়া কাজ করতেই পারেনা, তা বোঝনা কেনো?
-বাঃ রে, একাত্ম দুটো মন একত্রে ঘুরবে, স্ফূর্তি করবে; এতে বেলেলস্নাপনার কী আছে, কেরিয়া ঘোরতর আপত্তি জানায়।
-কেনো, তুমিই বলো আমরা স্বামী-স্ত্রী নাকি যে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরবো! এসব করতে গিয়েই তো প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকা ধর্ষিতা হয়, প্রেমিক কর্তৃক অবৈধ গর্ভধারণ এবং সমত্মানের পিতৃপরিচয়ের দাবীতে প্রেমিকার দূর্গতির খবর পড়নি পত্রিকায়? তাছাড়া প্রেমের নামে অবৈধ সম্পর্ক গড়ার পর বিয়ে করতে অস্বীকার করায় প্রেমিকার আত্মহত্যার খবরতো প্রায়ই শোনা যায়---
-ওরে বাপরে, থামাও থামাও তোমার লেকচার, অধৈর্য হয়ে কাকলীকে বাধা দেয় সে-- তোমার একটাই দোষ, ধর্ম মেনে যে প্রেম হয়না তা তুমি বুঝতেই চাও না?
-ঠিক আছে, তুমিই বোঝ আমি ক্লাশে চললাম, বলে রাগে গড়্ গড়্ করে চলে যায় কাকলী।
*
-এইযে ছাওয়ার বাপ, হঠাৎ ময়নার ঠাট্টায় স্রোতস্বিনী ভাবনায় ছেদ পড়ে যায় ওর। ছাওয়াটার একনা ভাল্ নাম থোয়ার কথা ভাবেন বাড়িত্ যায়য়া, মুই ইয়াক দুধ খোয়য়া দিয়া আসিম এ্যালা--- বুঝনেন?
-ধুর্ ময়না, তুই এইগস্না কী কইস্, এ্যাঁ---লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়ে--ঠিক আছে মুই গেনু, বলে চলে যায় কোরিয়া।

ওদের দু’জনের বাড়ির পারস্পারিক দূরত্ব তিনশো গজ প্রায়। সকাল এখন এগারোটা বাজে। ভাগ্যিস, আজ ভোরে নাসত্মা ও দুপুরের ভাত একত্রেই রেuঁধ রেখেছে। গ্রামের মানুষ এবং ঝামেলা কম বলে সকালের নাসত্মা হিসেবে প্রায়শ: ভাতই খায়। বেশীর ভাগ ÿÿত্রে সকালে দুপুরের তরকারীও রেuঁধ রাখে। কোনদিন রাঁধতে না পারলে ডিমভাজি ও আলুভর্তা দিয়ে দিব্যি চালিয়ে দেয় সে। আজ এসব ঝামেলায় তরকারী রাঁধতে পারেনি বলে চিমত্মায়ও পড়ে যায়। ময়না ছেলেটাকে দিয়ে গেলে রান্নার আর সুযোগই পাবেনা বলে তড়িঘড়ি তরকারী রান্নায় নেমে পড়ে সে। ছয়টা দেশী-বিদেশী মুরগী আছে বলে ওর ডিমের অভাব হয়না। তিনকাঠার বাপের ভিটিতে আট-দশটা আম-কাঁঠালের গাছও আছে। টিনের একটা ঘরে সে ঘুমায় আরেকটা ঘরে মালামার থাকায় সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। আরেকটা হচ্ছে রান্নাঘর। টিউবয়েলের পানি আনতে গিয়ে নজরে পড়ে ওর দুটো মোরগ-মুরগীর অভিসারের দৃশ্য। কেন যেন হাসি পায় ওর, ভাবে--পৃথিবীতে এই জিনিসটাই যত অঘটনের মূল! নতুবা মাথায় কী চাপলো, আর অমনি বেসামাল হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরবোই বা কেন? ছিঃ ছিঃ সব দোষতো আমার, কাকলীর কী দোষ? আর ছ্যাঁক খেয়ে বিয়ে করিনি বলে সবাই ডাকে আজ চিরকুমার! বয়সও তো ত্রিশ পার হতে চললো, এভাবে আর কদ্দিন---একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার রান্নাঘরে ঢোকে কোরিয়া। অতপর চুলায় ডিম চড়িয়ে পুনরায় তলিয়ে যায় ভাবনার অথৈ সাগরে।


সেদিন জ্বরের দরম্নণ কলেজে যায়নি কোরিয়া। পরীÿার বাকি মাত্র পনের দিন। কিছু জরম্নরি নোটের প্রয়োজনে কলেজে খুঁজে না পেয়ে কোরিয়ার বাড়িতে যাবার সিদ্ধামত্ম নেয় কাকলী। এর আগেও দুয়েকবার এসেছিল সে। কলেজছুটির পরই রওনা দেয় কাকলী। ওর বাসা কলেজের কাছাকাছি হলেও কোরিয়ার বাড়ি থেকে আধামাইল দূরে। বিকেলের পথ-ঘাট ফাঁকা-ফাঁকা, ছোট্ট রশহরের রাসত্মায় তেমন ভিড় নেই। প্রখর রোদ মাড়িয়ে রিক্সায় দ্রম্নতই চলে আসে সে। রিকসা থেকে নেমেই ডাক দেয়, কেরিয়া--- এই কোরিয়া----। ডাক শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে কোরিয়ার ছোটবোন, ওঃ আপনি, ভালো আছেন আপা? আসেন, ভাই ঘরেই আছে-----  
          -কী সৌভাগ্য আমার, গরীবের ঘরে হাতির পা যে? কোরিয়াও ডাক শুনে বেরিয়ে বাইরে।
এরপর ওর ছোটবোন চলে যায় অসুস্থ বাপের ঘরে আর কোরিয়া কাকলীকে নিয়ে ঢোকে নিজের ঘরে।
          -শোন, দেরী করবো না কিন্তু। তোমার ইংরেজি আর পদার্থের নোট দুটো নিতে এসেছি, বরে কাকলী।
          নিয়ো, এত তাড়ার কী আছে। বসো, একটু চা-টা খাও----
          -না গো, দেরী হলে আবার কৈফিয়ত দিতে হবে, জানোই তো?    
          -ঠিক আছে বসো, আমি নোটগুলো খুঁজি---বলেই কোরিয়া দ্রম্নত গিয়ে খিল লাগিয়ে দেয় ওর ঘরের দরজায়।
          -কী ব্যাপার, দরজা বন্ধ কররে কেন? কাকলী অজানা আতঙ্কে তড়াক করে ছেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। - না, মানে বহুদিন পর এলে তো; একামেত্ম কিছু কথা বলবো আরকি? বলামাত্রই ওকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে কোরিয়া।
          ছিৎ ছিঃ কোরিয়া, ছাড়ো, ছেড়ে দাও, চিৎকার দেবো কিন্তু---বলে ওর বলিষ্ঠ বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে সে।       

হঠাৎ চেঁচামেচি, ধসত্মাধসিত্মর আঁওয়াজ আর মেয়েলী কণ্ঠ শুনে পাশের ঘর থেকে ওর বাপ চেঁচিয়ে ওঠে- কোরিয়ার ঘরে কে রে, মা? এতেই ভয়ে কাকলীকে ছেড়ে সে আর অমনি দরজা খুলে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে যায় সে। অতপর বেম কয়েক বছর কেটে যায় দেখা হয়না দু’জনার সাথে দু’জনার। বরং এইচএসসি পাশের পর বিয়ে হয়ে যায় কাকলীর। ফলে কোরিয়াও ওয়াদা করে বসে, জীবনে সে আর বিয়ে করবেনা! আজ কিনা সে চিরকুমার কোরিয়াই রেডিমেড সমত্মানের বাপ? আবার ছেলের রেডিমেড মাতাও জুটেছে একজন----এসব ভেবে আপনমনেই হাসে একচোট!

দুপুরের খাবার খেতে খেতে দুটো বেজে যায় কোরিয়ার। তখনও আসেনা ময়না। তাই কিছুটা টেনশনবোধ করে। ভাবে, মেয়েটা বড়বেশী খামখেয়ালী। তবে কি ওকে ÿÿপানোর জন্যই দেরী করছে সে? অবশ্য ওরচে ময়নার কাছেই যে ভালো আছে ও থাকবে ছেলেটা, এটা ভেবে পরÿণে শামত্ম হয় । শরীরটা ক্লামত্ম থাকায় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আকাশ-পাতাল চিমত্মা করতে থাকে সে। নারীজীবনের পূর্ণতা ও সার্থকতা নাকি মাতৃত্বে। নতুবা পরিপূর্ণ বৈষয়িক সুখসম্ভোগের পরও নিসমত্মান নারী অমত্মর্জ্বালা নিয়েই বা মরে কেন? এইযে ময়না একজন সমত্মানহীনা নারী, স্বামীসুখ সম্ভোগের পর সাময়িক বঞ্চিত হলেও খুব একটা অসুখী থাকার কথা নয়। কিন্তু বন্ধ্যা হিসেবে সমত্মানহীনতার যে অভাববোধ ও অতৃপ্তি তার কি কোন নিরাময় বা বিকল্প আছে! কেবলমাত্র একটি চাঁদমুখ সমত্মানই পারে সে অভাব দূর করতে? একারণেই হয়তো বাচ্চাটা পেয়ে কিছুটা হলেও তৃপ্তির হাসি ফোটে ময়নার মুখে। এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন গড়মত্ম বিকেল, সন্ধ্যার বেশী দেরী নেই। মোরগ-মুরগীর কক্ কক্ আঁওয়াজে আঙ্গিনা মুখরিত। নবজাতকের কথা স্মরণ হতেই দ্রম্নত ছুটে যায় ময়নাদের বাড়ি। উঠোনে ময়নার বা কে পেয়েই শুধায়--চাচা, ছাওয়া কই ময়না কোনটে?
-একনা ব্যাড়বার গেইছে, এ্যালায় আইসপে----বইসো ক্যানে, চাচা হেসে হেসে বলেন, কুব দেখি মায়া ধরি গেইছে বাহে? কোরিয়া লজ্জায় মুখ ঢাকে যেন। এমন সময় দেখা যায়, বাচচা কোরে ময়না বাড়ির দিকে আসছে। কোরিয়ার কেন যেন মনে হয় কতদিন দেখেনা ছেলেটাকে। তাই কোরে নেয়ার লোভ সামলাতে না পেরে ছুটে যায় ময়নার কাছে।
-কী ছাওয়ার বাপ, ছাওয়ার নাম তুইনেন, নাকি হামরায় থোমো? দেখা হওয়ামাত্র ময়না কৌতুক করে বরে আর মিটিমিটি হাসতে থাকে।
-মুই বাপ হইলে তুই কি মা-ও নাকি, অ্যাঁ----ঠাট্টার মোÿম একটা জবাব দিতে পেরে খুব খুশী হয় সে। কিন্তু ময়নার জবাব শুনে তো একেবারে থ’!
-মা-ও হইলেই বা কী, মোর তো বিয়াও হছলো, মা-ও কওয়া যায়। কিন্তু তোমরা বিয়াও না করি ছাওয়ার বাপ্ হন্ ক্যামন করি, কন্তো?


পৌরম্নষে আঘাত লাঘায় চরম লজ্জায় ঘেমে ওঠে কোরিয়া। আর বাচ্চাকোলে হাসতে হাসতে পালায় ময়না।সে-ও পিছু পিছু চলে আসে ওদের বাড়িতে। ময়নার বিদ্রম্নপাত্মক কথাগুলো দারম্নণ ভাবিয়ে তোলে ওকে। কী ইঙ্গিত করে ময়না, বুঝতে বাকি থাকেনা ওর। সত্রি তো, বিবাহিত নারীকে অনায়াসে সমত্মানের মা বলা যায়। কিন্তু অবিবাহিত একজন পুরম্নষকে সমত্মানের বাপ বলাটা হাস্যকর বৈকি? নাহ্, ওকে নতুন করে ভাবতে হবে বিয়ের ব্যাপারটা। কাকলী বিয়ে করে সুখী হলে, সে-ই বা বোকার মতো চিরকুমার থাকবে কেন? এতদিন পর বিয়ের সত্যিকার একটা যৌক্তিকতা যেন খুঁজে পায়! তাছাড়া ময়নার মতো মেয়েরা সংসারী ও গুণবতী। হেক না সে এসএসসি ফেল, স্ত্রী হবার সব গুণ আছে ওর। আবার জোহর আলী চাচার মুখোমুখি হতেই সুখস্বপ্নগুলো কোথায় মিলিয়ে যায়। সুতরাং থতমত খেয়ে শাসনের ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ময়নার দিকে, সারাদিন ছাওযাটাক নিয়া গেলু না ক্যা, ময়না?
-আববা কইল্, তোমরা চ্যাংড়া মানুষ, ইয়ার যমত্মনা সবার পাবার নন। তাই----
-হ্যাঁ বাহে, তোমার বউ-বাচ্চা নাই; খুব কষ্ট হইবে তোমার। কথাটা আগোৎ কবার চাচনু, এ্যালা কং। মোর ময়না মা-ই পুষুক বাচ্চাটাক, কী কন বাহে? কথাকেড়ে নিয়ে মেয়ের পÿÿ একটানা বলে যান চাচা। কোরিয়ার ভাবামত্মর বোঝা যায় না এতে, মনে হয় খুশীই হয়! কারণ ছেলেটা মাতৃস্নেহে মানুষ হবে, এটাইতো পরম পাওয়া? কিন্তু ময়নার কাছে মানুষ হলে ছেলেটা কি চিনবে ওকে, বাবা বলেও ডাকবে তো--এটাই ওর দুশ্চিমত্মা? তবে বাচ্চাটার সবার্থে মনকষাকষিতে যেতে চায়না সে। তাই মাথানেড়ে সম্মতি জানিয়ে ভারমুক্ত হয়ে চলে যায় বাড়ীতে। 

.ময়নার সাথে কোরিয়ার বিয়ের আয়োজন চহড়ামত্ম, জমজমাট বিয়ের আসর! বিয়ের কাজী এবং মাওলানাও প্রস্ত্তত। ওর মনে আজ অব্যক্ত আনন্দের ঢেউ! কিন্তু হঠাৎ ঘরের মোরগগুলোর সমবেত কুক্ কুরম্ন কুক্ চিৎকারে সুখস্বপ্নটা টুটে যায় ওর? সুখানুভহতিটা এখনো লেগে আছে ওর মনে! রাতে ঘুমানোর আগে সে ময়নাকে বিয়ের পাকাপোক্ত সিদ্ধামত্মই নিয়ে রাখে। হয়তো এরই প্রতিফলন ঘটে স্বপ্নে, ভেবে খুব ভালো লাগে ওর। ফজরের আজান হবে হবে, চারিদিকে হালকা কুয়াশার ভাব। ব্রাশ করতে করতে মসজিদের দিকে রওনা দেয় সে। যতই এগোয় শীতার্ত প্রকৃতিটা ততই ধোঁয়াটে ও ঘোলাটে দেখা যায়। বড়রাসত্মা ধরে দ্রম্নততালে হাঁটতে থাকে সে।  ইমাম সাহেবের সাথে করে তাকেই বিয়ের ঘটক করে পাঠাবে আজ। বিয়ের আনন্দে আবেগতাড়িত সে, পা দুটো তাই এমনিতেই দৌঁড়ায় যেন!

বিকেলে জ্ঞান ফিরলে পরিস্থিতি কিছুই বুঝে উঠে পারেনা। প্রথমে সে চোখেও দেখতে পায়না কিছুই? শরীরে প্রচন্ড বেদনা অনুভব করলেও চোখ কচলাতে কচলাতে সামনে তাকানোর কোশেশ করে। কোনকিছু যেমন ঠাঁওর করতে পারেনা তেমনি সামনের সবকিছু ধোঁয়াটে-অস্পষ্ট মনে হয়। কিন্তু কিছু ভুতুরে চেহারা দেখে আঁতকে ওঠে এবং তড়িঘড়ি উঠে বসতে গিয়েই ’উহ্’ বলে পড়ে যায় বেডে। আমি কোথায়, তোমরা কারা, ভয়ার্ত প্রশ্ন ওর!
-আমরা নার্স, এটা হাসপাতাল। আপনি এক্সিডেন্ট করেছেন, একজন জবাব দেয়।
-উহ্ বাবারে, আমার পায়ে কী হয়েছ; উঠে বসতে গিয়ে সদ্য অপারেশনকৃত পায়ের ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে? কিন্তু ব্যালান্স হারিয়ে বেডে পড়ে গিয়ে ডুঁকরে কেঁদে ওঠে---আমার পা কই, আমার পা-----
-আপনি নড়াচড়া করবেন না, শুয়ে পড়ুন---নার্সরা ওকে শুইয়ে দিয়ে শামত্মনা দিতে থাকেন।
-কোরিয়া ভাই, চিমত্মা করেন না ভাল্ হয়য়া যাইমেন্----। ময়নাও বুকফাঁটা কান্না চেপে মিথ্যে সামত্মনা  দেয়, ভয় কিসের হামরা আছি না! 


-এ মূহুর্তে কোরিয়া না বুঝলেও ময়না ঠিকই জানে যে, সে আর কোনদিন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে না। ঘাতক ট্রাক ওর দুটো পা-ই হাঁটু পর্যমত্ম চহরমার করে দিয়েছে। ভাল্ মানুষটার যে কী হয়য়া গ্যালো, বাচ্চার জন্যও আর কোনদিন কিছু কিনবার পাবার নয়? অবশ্য ময়নাও যে, ওকে নিয়ে কখনো স্বপ্ন দেখেনি তা অস্বীকার করা যাবেনা। সাতপাঁচ ভাবতে গিয়ে ময়নার চোখ ফেটে তাই অশ্রম্ন ঝরে টপ্ টপ্ টপ্------। আর সেই অশ্রম্ন কোলের শিশুর চোখে-মুখে পড়তেই চেঁচিয়ে ওঠে----ঁওয়া---ওঁয়া---ওঁয়া----। নবজাতকের কান্নায় যেন সম্বিৎ ফিরে পায় কোরিয়া, কী হৈল্ ময়না, ছাওয়াটা কান্দে ক্যা? দে তো মোর কোলোত্--- বলেই হাত বাড়ানোর চেষ্টা করে ময়নার দিকে!!        
-