গণমাধ্যমের তথ্যচিত্রঃ
পরিবেশবিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ
শাহ আলম বাদশা
বিশ্বব্যাপী পরিবেশবিপর্যয়ের ভয়াবহতা এখন আর কারুরই অজানা নয়। বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারে আত্মহারা ও অপরিণামদর্শী মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করে পরিবেশের ওপর ক্রমাগত যে নিষ্ঠুর আচরণ করে এসেছে, স্রষ্টা এবং রুদ্র-রূষ্ট প্রকৃতিও যেন তার বদলা নিচ্ছে কড়ায়-গন্ডায়। অগ্নুৎপাতের বিপর্যয় জলবায়ূর তীব্র পরিবর্তন, সিডর, টর্ণেডো, ঝড়, বন্যা-খরা, এসিডবৃষ্টি, ভূমিধস, পাহাড়ধস, তীব্র পানিসংকট, আগ্নেয়গিরির, দাবদাহ, পানিদুষণ, শব্দদুষণ, এইড্স-বার্ডফ্লুর মতো প্রাণঘাতি রোগের প্রাদুর্ভাব, বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাসের মারাত্মক প্রাবল্য, ভূ-গর্ভ্যস্থ পানির আশংকাজনক স্তরে নেমে যাওয়া ও আর্সেনিক বিষে একাকার হওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হওয়া ইত্যাকার আতঙ্ক সমগ্র সৃষ্টিকে আজ এক মহাপ্রলয়ের পদধ্বণিই শোনাচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্টমিডিয়ার বদৌলতে পৃথিবী আজ অত্যন্ত ছোট হয়ে আসায় সারাবিশ্বের মানুষ এখন এসব খবর যেমন দ্রুত জানতে পারছে, তেমনি হচ্ছে পরিবেশসচেতন এবং প্রতিবাদীও। অথচ আগের দিনে আমরা এতদ্রুত পরিবেশবিপর্যয়ের কথা জানতেই পারতাম না।
ইদানিং বিশেষত: প্রিন্টমিডিয়া বা পত্রিকার পাতায় মাঝে মাঝে ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা করো, সুন্দরবন বাঁচাও, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও’ ইত্যাদি শিরোনামযুক্ত খবর দেখলেই বর্তমান পরিবেশসচেতনতা সম্পর্কে আন্দাজ করা যায় যে, মানুষ এখন কতটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কগ্রস্ত! কিন্তু তবুও কি নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় পরিবেশের বিপর্যয়রোধ করা আদৌ সম্ভব হচ্ছে? মানুষ ও প্রাণী শুধুই নয়, আজ ব্যাঙ-কচ্ছপ, কেঁচো, শামুক-ঝিনুক এমনকি সাপের জীবনও সংকটাপন্ন। ফলে প্রকৃতির আবহাওয়া ও পরিবেশে চলছে বিশৃঙ্খলা এবং ভারসাম্যহীনতা। বিশ্বের মানুষ যখন পরিবেশবান্ধব বায়োডিগ্রেডিবল পলিথিন, বায়ুবিদ্যুৎ এমনকি সৌরবিদ্যুৎ পেতে সোলার ফটোভোল্টিক সেল নির্মিত ছাদসহ আরও হরেক রকম জিনিস ব্যবহার করে যাচ্ছে, সেখানে আমরা এখনও কিন্তু পরিবেশ সচেতনতাসৃষ্টি, কালোধোঁয়ারোধ, আর্সেনিকমুক্ত পানিপান আর বৃক্ষরোপন আন্দোলন নিয়েই ব্যস্ত আছি। ০৪ জুলাই বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের জোট সিএসআরএস সংবাদ সম্মেলনে বলেছে যে, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলোতে কৃষি ও খাদ্যের উৎপাদনে যে প্রভাব পড়ছে, তাতে ২০২০ সালের মধ্যে ২৫% থেকে ৪০% গ্রিনহাউস গ্যাসনির্গমন কমানো না গেলে ভবিষ্যতের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবেনা। ---জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য জি-৮সহ উন্নতবিশ্বের দেশগুলোকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে।’’ দেশের পরিবেশদুষণের অবস্থা বর্তমানে কোন্ পর্যায়ে গেছে, তা আন্দাজ করার জন্য এখানে দেশের প্রধান কয়টি পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম ও কিছু সংক্ষিপ্ত সংবাদ তুলে ধরা হলোঃ
১.‘‘২০২০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন না কমালে ভবিষ্যৎ বিপর্যয়কর (দৈনিক সমকাল-০৫/০৭/২০০৮)
২.‘‘গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ায় মহাবিপর্যয়ের মুখে পৃথিবী; বাংলাদেশের দেড়কোটি মানুষ ঘরবাড়ি হারাবে (দৈনিক যুগান্তর-২৩/০৩/২০০১)।’’
৩. ‘‘চট্টগ্রামেও পাহাড়ধস, বিকট শব্দে ২০০ফুট জায়গা নিয়ে ৩০ফুট দেবে গেছে বান্দরবানে (দৈনিক সমকাল-০৫/০৭/২০০৮)।
৪. ‘‘প্রতিবছর বাতাসে ৫০টন সীসা (দৈনিক জনকন্ঠ-২৬/০২/৯৯)।’’
৫.‘‘ফারাক্কার সর্বনাশা ছোবলে দক্ষিণ ও পশ্চিমোংশের কৃষি, শিল্প, বনজ ও মৎস্যসম্পদ এবং পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে (দৈনিক ইনকিলাব-০৯/০৩/২০০২)।’’
৬.‘‘ঢাকা বিশ্বের সবচে দুষিত নগরী (০৯/১১/২০০১-দৈনিক যুগান্তর)।’’
৭.‘‘গত এক শতাব্দীতে বাংলাদেশে বিলুপ্ত হয়েছে ১৩ রকমের মেরুদন্ডীপ্রাণী, বেশ কয়েক প্রজাতির মাছ এবং ৭০০ প্রজাতির মিঠা ও লোনাপানির মাছের মধ্যে ৫৪টিই ইতিমধ্যে বিলুপ্তির পথে (০৪/০১/২০০২-দৈনিক-ভোরের কাগজ)।’’
৮.‘‘চিকিৎসা বর্জ্যে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য হুমকিতে (০৭/০৪/২০০১-দৈনিক-ভোরের কাগজ)।’’
৯.‘‘ট্যানারি দুষণে হাজারীবাগের চামড়া কারখানাগুলোতেই প্রতিদিন উৎপন্ন হচ্ছে ৭.৭০ মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য এবং ৮৮ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য (দৈনিক ইনকিলাব-১৬/০২/২০০২)।’’
১০.‘‘ট্যানারি দুষণে হাজারীবাগের ৫লাখ মানুষের জীবনবিপর্যস্ত (দৈনিক জনকন্ঠ-২৬/১২/১৯৯৯)।’’
১১.‘‘সরকারি হিসাবমতে, দেশের ৬৪ জেলার ৬১টিতেই ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক। দেশের প্রায় ৩কোটি মানুষ সরাসরি আর্সেনিক বিষক্রিয়ার শিকার। সরকারি হিসাবমতে আর্সেনিক দুষণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ১০হাজার। (দৈনিক ভোরের কাগজ-২৬/০১/২০০২)।’’
১২.পানিদুষণের কারণে বারিধারা লেকের ৫কোটি টাকার মাছের মড়ক (দৈনিক যুগান্তর-১৯/১১/২০০২)।’’
১১.‘‘একটি দেশের জন্য ২৫% বনভূমি থাকা আবশ্যক। অথচ বাংলাদেশে এই হার মাত্র ৬-৮% (The Bangladesh Observer-02-12-2001)’’
১৩.বায়ুদুষণের কারণে ঢাকায় প্রতিবছর ১৫হাজার লোকের মৃত্যু (The Daily Star-15-02-2002)
এভাবেই প্রতিনিয়ত পরিবেশদুষণের শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য, আসেনিকে একাকার হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। জুমচাষে বিলীন হচ্ছে পাহাড়ি জমি, হচ্ছে অবাধ বৃক্ষনিধন। গ্রিনহাউজ গ্যাসের আধিক্যে ক্রমশ: বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে বাতাস, প্রচন্ড শব্দদুষণে বিগড়ে যাচ্ছে মস্তিষ্ক। তাইতো বিজ্ঞানীরা স্বভাবত;ই দাবী করছেন যে, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা তলিয়ে যাবে সমুদ্রগর্ভে। সুতরাং নিজেদের ভোগলিপ্সার স্বার্থে পরিবেশধ্বংসের তান্ডবলীলা বন্ধ না করে শুধুই মাস্ক ব্যবহার করলে হয়তো সাময়িক আত্মতৃপ্তি পাওয়া যাবে; কিন্তু আবিস্কারের নামে বিজ্ঞানের নামে প্রকৃতিধ্বংসের কাজ চলতে থাকলে সুদুরপ্রসারী এই বিপর্যয় থেকে বাঁচা যাবেনা আদৌ?
বাংলাদেশ দরিদ্রদেশ হলেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পরিবেশসংরক্ষণেও নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচেছ। সরকারিভাবে ছযবিভাগে পরিবেশ আদালতগঠন, কালোধুঁয়া বন্ধে ২০বছরের পুরনো যানবাহন নিষিদ্ধকরণ, বৈদেশিক সাহায্যে আর্সেনিক মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রকল্পগ্রহন, ব্যাপক বৃক্ষরোপন আন্দোলন, সবুজায়ন প্রকল্প, নদীতীর সংরক্ষণ ও নদীখনন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সুন্দরবন সংরক্ষণসহ নানারকম কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রতিবছর পরিবেশ দিবস পালন ছাড়াও ইলেক্ট্রনিক্স এবং প্রিন্টমিডিয়াতেও পরিবেশরক্ষার পক্ষে ব্যাপক ক্যাম্পেইন চলছে। এসময়ে পাঠ্য-পুস্তকে পরিবেশ বিষয়ক প্রবন্ধযুক্তকরন ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিবেশ বিজ্ঞানসংক্রান্ত আলাদা বিভাগ চালুকরণও একটি শুভলক্ষণ বৈকি। পরিবেশসচেতনতা দিনদিন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি নির্মল ও বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার আকুতিও জোরদার হচ্ছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আজ থেকে ৩৫বছর পূর্বে স্টকহোমে জতিসংঘের প্রথম পরিবেশবিষয়ক সম্মেলনেই সূচিত হয়েছিল এ পরিবেশসচেতনতা কার্যক্রম, যা বর্তমানে দেশে দেশে গড়ে তুলেছে পরিবেশবিষয়ক আন্দোলন।
পরিশেষে বলা যায় যে, নিজেদের অস্তিত্বরক্ষায় বিশেষত: বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে এবং সুস্থ-সবল জীবন চাইলে অবশ্যই আমাদের ত্যাগ করতে হবে যুদ্ধসাজ, ধ্বংস করতে হবে সব এটম, নাপাম, পারমানবিক বোমসহ পররেবেশ ধ্বংসকারী আগ্নেয়াস্ত্র আর বন্ধ করতে হবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে আত্মঘাতি লড়াই!
****************