30.5.11


কন্যাশিশু ও নারীনির্যাতন এবং তাদের যৌননিরাপত্তা
   শাহ আলম বাদশা
         
ডাক্তার গৃহকত্রীর নির্মম নির্যাতনে ছোট্ট গৃহকর্মী রুবি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বয়স ১২ কি ১৩ হবে। গরম খুনতির ছ্যাঁকা আর নির্মম পিটুনির দগদগে দাগ ওর সারা শরীরে। পুলিশের কাছে ওর প্রদত্ত জবানবন্দীর সারমর্ম হচ্ছে--একবছর যাবৎ সে চারসদস্যবিশিষ্ট ওই ডাক্তার দম্পতির বাসায় গৃহকমীর কাজে নিয়োজিত। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, হঁড়ি-পাতিল মাজা, ঘরদোর ঝাঁড়ু দেয়া ও মোছা, কাপড় কাচা এবং তিনবেলা  নাস্তা ও খাবার পরিবেশন করতে হতো ওকে। কোন অবসর দেয়া হতো না। কাজের ফাঁকে বা অবসরে তাদের সাথে বসে বা পাশে দাঁড়িয়ে কখনো টিভি দেখলেও খেঁকিয়ে উঠতেন গৃহকর্ত্রী সোমা। শিশুসুলভ আচরণের দরুণ কখনো টিভিরুম ছেড়ে যেতে একটু দেরি হলেই গালে-মুখে চড়-থাপ্পড় অথবা চুলধরে কিল-ঘুষি মারতেন তিনি। কখনো কখনো তার স্কুলপড়ুয়া দু‘ছেলে-মেয়েকেও লেলিয়ে দিতেন ওকে মারার জন্য।  আর যদি ওর হাত থেকে কোন জিনিস, তরকারি পড়ে বা ভেঙ্গে যায়, তাহলে ততক্ষণাৎ গায়ে গরমপানি ঢেলে দেয়া, শরীরে ছ্যাঁকা দেয়াছাড়াও হাতের কাছে যা পাবেন তা-ই দিয়ে শুরু করবেন বেদম পিটুনি। সে সময় ডাক্তার গৃহকর্তা বাসায় উপস্থিত থাকলে তিনি সরাসরি বাধা দিতেন বা পুলিশের ভয় দেখিয়ে ওকে উদ্ধার করতেন।

নিজের সন্তানদের মতোই একজন রক্ত-মাংসের শিশু হিসেবে গৃহকর্ত্রী কখনো আদর করতেন না ওকে বা নিজের  সন্তানদের মতোন ওর দোষ কিংবা ভুল হলেও ক্ষমা করতেন না। গৃহকর্তা এক্ষেত্রে ভালো মানুষ ছিলেন।

এ গেলো চিত্রের একপিঠ, আবার অপরপিঠও আছে। গৃহকর্তা বা তার সন্তান কর্তৃক কাজের মেয়েকে ধর্ষণ, হত্যা অথবা প্রলোভিত করে গর্ভবতী করার মত ঘটনাতো বাংলাদেশে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী, পথচারী কিশোরী- সুন্দরী নারীদের প্রকাশ্যে উত্যক্ত করার পাশাপাশি অবুঝ শিশুদেরও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা কার না জানা? রিমি, সিমি, স্বপ্নাসহ নাম নাজানা আরো অনেক মেয়ের আত্মহত্যা বা অপমৃত্যুর কথা হয়তো এখনো অনেকের স্মরণ থাকার কথা। ইদানিং আবার মোবাইলে নারীনির্যাতনের বিষয়টিও নবমাত্রা যোগ করেছে। ইভটিজিং বা প্রকাশ্যে অশ্লীলতা প্রদর্শন, উত্যক্তকরণের সঙ্গে শুধু মফস্বল বা গ্রাম-গঞ্জের মেয়েরাই আজ পরিচিত নয় বরং রাজধানীর মেয়েরাও এর শিকার হয় মারাত্মকভাবে।

মেয়েদের উত্যক্তকরণের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন আইন না থাকলেও নারী ও শিশুনির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন-২০০৩ এর আওতায় এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়া যায়। নারী ও শিশুনির্যাতন দমন আইন-২০০৩ অনুসারে কোন নারী সম্ভ্রমহানীর কারণে আত্মহত্যা করলে, আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে।

কিন্তু অপরাধ প্রমাণের ঝামেলা, বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা, আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণের ফলে আরো বেশি নিরাপত্তাহীনতা বা হয়রানির আশংকা, সামাজিক লজ্জা ইত্যাদির দরুণ অধিকাংশক্ষেত্রেই অভিভাবকগণ আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হননা। ফলে বখাটেরা দ্বিগুণ উৎসাহে এ সকল কাজ করতে থাকে। কিন্তু অভিভাবকগণ ন্যায়বিচার প্রাপ্তিসহ দ্রতবিচারসম্পন্নের আশ্বাস এবং নিশ্চয়তা পেলে হয়তো আইনগত প্রতিরোধ ও প্রতিকারে এগিয়ে আসতে আগ্রহী হবেন। বাংলাদেশের দন্ডবিধি অনুযায়ীও এ ধরণের অপকর্মের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। দন্ডবিধির ২৯৪ নং ধারানুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি অন্যকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যস্থানে অশ্লীল কার্যকলাপ বা অশ্ল­ীল গান, আবৃত্তি বা উচ্চারণ করে, তবে সে ব্যক্তি যেকোন বর্ণনায় কারাদন্ড যার মেয়াদ ৩ মাস পর্যন্ত হতে পারে বা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে। দন্ডবিধির ৫০৯ নং ধারামতে, যদি কোন ব্যক্তি কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার উদ্দেশ্যে কোন মমত্মব্য করে বা কোন শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোন বস্ত্ত প্রদর্শন করে, তবে সে ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদন্ড যার মেয়াদ ১ বছর হতে পারে বা জরিমানা বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবে। নারীদের উত্ত্যক্ত করার ক্ষেত্রে বিধান আছে তিনমাস বা ১ বছরের কারাদন্ড কিংবা দু’হাজার টাকা জরিমানা।

চাকরি ও কর্মক্ষেত্রে নারীরাসহ স্কুল-কলেজ বা ভার্সিটিতেও ছাত্রী-নারীসহকর্মীরাও অনেকক্ষেত্রে মানসিক ও যৌননির্যাতনের শিকার, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানাকারণে অগোচরে থেকে যায়। কর্মজীবী সুন্দরী ও আকর্ষণীয় নারী বিশেষত যুবতীরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের বস্ বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তার দ্বারাও যৌননির্যাতনের শিকার হন। স্কুল-কলেজে সহপাঠি এমনকি শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী-উত্যক্তকরণ, ধর্ষণ ইত্যাদির ঘটনায় তো ঢাকার বিভিন্ন ভার্সিটি বেশ কুখ্যাতি অর্জন করেছে। একসময় ঢাকা ভার্সিটির নেতৃস্থানীয় ছাত্র কর্তৃক ছাত্রীধর্ষণের সেঞ্চুরিপালনের মত সদম্ভ ঘোষনাও পত্রিকান্তরে শুনতে হয়েছে এ জাতিকে, কী দুর্ভাগ্য আমাদের! কিন্তু শতাধিক ছাত্রীর সম্ভ্রম ও জীবন-মান ধ্বংস করার পরও সেই নরপশুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে কি? যদি তা হতো, তবে আজ ধর্ষিতা- নির্যাতিতা মেয়েদের অভিাবকরা লুকিয়ে লুকিয়ে না কেঁদে নিশ্চয়ই দলে দলে আইনের আশ্রয় নিতে লাইন দিতো।

এটা ঠিক যে, অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্যই হরেকরকম অপরাধদমণ আইন-কানুন তৈরি হয়েছে এবং শিশু- নারীনির্যাতনকারীদের আইনি প্রক্রিয়ার হাত থেকে রেহাই দেয়াও যাবেনা। তবে এও স্বতসিদ্ধ ও প্রমাণিত সত্য যে, নিছক আইনের মাধ্যমেই এ সামাজিক অবক্ষয়মূলক অপরাধদমন পুরোপুরি সম্ভব নয়। এসব অপরাধের বিরম্নদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক গণসচেতনতা সৃষ্টি, ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, নারীদের আত্মরক্ষামূলক কুংফু-জুডো, কারাটে, মার্শাল আর্ট প্রভৃতি ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায়ণ করাও জরুরি। এজন্য শিক্ষার হার শতভাগে উন্নীত করা একান্ত আবশ্যক। বিশেষত নারীদের সুশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত করার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষায়ও উপযুক্ত করা দরকার, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে তাদের সমত্মানরা তাদের কাছেই মাতৃজাতি হিসেবে নারীদের যথাযথ সম্মানদানের সুশিক্ষা পায়। এক্ষেত্রে নেপোলিয়নের কথাটি প্রণিধানযোগ্য, ‘তোমরা আমাকে একটি ভালো মা দাও, আমি তোমাদের একটি উত্তম জাতি উপহার দেবো।’

আর ইসলামের ইতিহাসের সেই কাহিনীও এখানে স্মরণযোগ্য, নবপ্রতিষ্ঠিত খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে একজন বিধর্মী যুবতী নারী যেকোন কারণেই হোক একাকী দীর্ঘ নির্জনপ্রান্তর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল আর সম্ভ্রমহানীর ভয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা  করছিল। এমন সময় তার বিপরীত দিক থেকে একজন মুসলিম পুরুষকে আসতে দেখে সে ধর্ষণ ও নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্কে হঠাৎ বসে পড়ে থর্থরে কাঁপতে থাকে। কিন্তু ‘মা, আপনি কোথায় যাবেন, আপনার কোন ভয় নেই’--লোকটির ব্যতিক্রমী ও অভূতপূর্ব অভয়বাণী শুনে যুবতী বিশ্বাস করতেই পারছিল না যে, ইসলামের ছোঁয়ায় নারীধর্ষক ও হত্যারক পশুগুলো আজ আর আগের চরিত্রে নেই, পরিণত হয়েছে মহামানবে।

প্রকৃত ধর্মশিক্ষা অমানুষ-পশুকেও এরূপ মানবতাবাদী উত্তম মানুষে পরিণত করে থাকে। তাই, আমরা সকলে মিলে নিজ নিজ আবস্থান থেকে যদি এ ব্যাপারে ব্যাপক গণসচেতনতাসৃষ্টি করি, শিশু ও নারীনির্যাতনরোধে পাড়ায় পাড়ায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ি, ইভটিজিং প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি; তাহলেই নারী ও শিশুদের জন্য একটি স্বর্গীয় অভয়ারণ্য বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে