রেবার বিয়ে


শাহ আলম বাদশা

সুজনের অন্তরে নতুন একটা টেনশন যোগ হয়। রেবার কাছে সে পাকা ওয়াদাই করেছে, এবার বিএ পরীক্ষা দেবেনা। অথচ আববার নিকট কী মিথ্যেটাই না বললো? দুপুরে খাবার টেবিলে হঠাৎ শুধান তিনি---কিরে সুজন, তুই নাকি ঠিকমত পড়ছিসনে? কী সব করে বেরোচ্ছিস, শুনলাম?
 ঃ না ইয়ে, মানে--কে বললো আববা? অভ্যাসমত নীচুস্বরে জবাব দিয়ে তার গম্ভীরমুখে তাকাতেই ঘাবড়ে যায় বেচারা। আববার প্রশ্নটা একেবারেই অভিনব,  যা তাকে ভাবিয়ে তোলে।
ঃ চুপ কর্, পরীক্ষা কবে তা-ই বল্? এবারের ধমকে ঘাম ঝরতে থাকে ওর। রেবার ব্যাপারে নিশ্চয় জেনেছে আববা-- ভেবে শংকিত হয়।
ঃ এ-ই তো ১৬ এপ্রিল, আববা? পরীক্ষার জন্যই তো খাঁটছি, ডাহা মিথ্যেকথাটা বলে ফেলে সে। এরপর উভয়সংকটে পড়ে হাবুডুবুই খেতে শুরম্ন করে সে। পড়তে বসলেও যত দূর্ভাবনা এসে ভর করে ওর মাথায়। আজ রাতেও চরম দুশ্চিমত্মায় রীতিমত গলদর্ঘম হয়। পরীক্ষাবর্জনের মত কঠিন সিদ্ধামেত্মর পর খামোখা এভাবে পড়তে বসার কি কান অর্থ হয়? কিন্তু পড়ার ভান না করলেও বিপদ, আববা-আম্মা বা বড়ভাই জানলেই সর্বনাশ। সুতরাং পড়াশোনার নামে রেবার প্রেমপত্র কিংবা প্রেমের কবিতা লিখে সময় কাটানো ছাড়া আর উপায় কী। পরীক্ষাবর্জনের কথা ভাবলে কখনো সখনো অত্যমত্ম খারাপও লাগে। অত্যধিক খারাপ লাগলে প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গতেও মন চায়। পরক্ষনে কে ফিসফিসিয়ে বলে, প্রতিজ্ঞা ভাঙলে, রেবা তোমাকে কাপুরম্নষ ভাববে যে? অথচ পরীক্ষা যতই কাছে আসে, মন বলতে থাকে---কী বোকা তুমি, পরীক্ষা পাশের পর রেবা হবে গ্রাজুয়েট; আর তুমি কিনা থাকবে--? নাহ্--আর কিচ্ছু ভাবতে চায় না সে। এক্ষণে প্রতিজ্ঞাটা ভাঙ্গার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু ভেঙ্গেইবা কী লাভ, পরীক্ষার তো খুব দেরী নেই? পরমূহুর্তে আবারো দমে যায়। সত্যি, কলেজজীবনের স্মৃতিগুলো এখনও ভুলতে পারে না। বিএ দ্বিতীয়বর্ষের মেধাবী ছাত্র তখন। দ্বিতীয় প্রিয়ডে স্যার অনুপস্থিত থাকায় মাঠে বসে রেবার সাথে গল্পে মেতে ওঠে। কথাচ্ছলে রেবা বলে, আচ্ছা সুজন, তুমি যে আমাকে এতো ভালোবাসো-- তার প্রমাণ দিতে পারবে?
ঃ কেনো, প্রমাণ চাও নাকি? আবেগী সুজনের পৌরুষে আঘাত লাগে। আলবৎ, চাইলে এক্ষুনি দিতে পারি--রেবার ঠাট্টাকে গুরুতরভাবে নেয় সে।
ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ চাই, রেবাও মিটিমিটি হাসতে থাকে।
 ঃ ঠিক আছে, বিএ পরীক্ষাই বর্জন করলাম--আগুপিছু  না ভেবে ছুঁড়ে দেয় অপরিণামদর্শী প্রতিজ্ঞাটা।
ইস, এটা তোমার মুখের কথা? রেবাও কৌতুক করে।
আল্লাহর কসম বলছি, তোমার সাথে পরীক্ষা দেবোই না এবার। কসম শুনে রেবা প্রথমটায় আঁৎকে ওঠে। পরক্ষণে হেঁয়ালী ভেবে, হয়েছে হয়েছে বাবা আর বীরত্ব দেখাতে হবে না, চলো-- বলে ক্লাশের দিকে হাঁটা দেয়। কিন্তু রেবার উপহাসে আবারো আত্মমর্যাদায় চরম আঘাত লাগে, এই ওর চরিত্র। ভাবে, রেবা ওর কথা বিশ্বাস করেনি! ঠিক আছে ওকে প্রমাণ দিয়েই ছাড়বে, এভাবে কঠিন সিদ্ধামত্ম নিয়ে ফেলে সে।
*****
আসলে সীমালংঘনের অবধারিত পরিণামের শিকার সুজন। মোহাবিষ্ট আলোর পেছনে ছুটতে গিয়ে আমও গেল ছালাও গেল, আর কী? আজ সে বাইরে বেরোয়নি। সোনালী বিকেলটাও উপভোগ না করে ঘরে বসে কাটায়। সন্ধার পর পড়ার টেবিলে গিয়ে ডিগ্রি পরীক্ষার অভিনয়ের মহরত শুরম্ন করে। কিমত্মু রোজকার মত রাজ্যের চিমত্মা এসে মাথায় জট পাকায়। এখন সে এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম যে, এতদিনে অমত্মত: ডিগ্রীপাশের পর কোন চাকরিতে অনায়াসে ঢুকতে পারতো। কিন্তু চাকরি দূরের কথা, এখনো কিনা ইন্টারমিডিয়েটের সেই পুরোনো সাইনবোর্ডই বয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ এবার ওর ছোটভাইও এমএ পরীক্ষার্থী! ইদানিং তাই জীবনটাকে অর্থহীন নয়, একটা মহাবোঝাও মনে হয়। প্রিয়বন্ধু দীপু ও আলমসহ সবাই চাকরির পাশাপাশি সুখ-থই-থই সংসার সাজিয়ে আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। আর সে কিনা বাবা-মার গলগ্রহ হয়েই থাকলো, বেকার? এ ত্রিশংকু অবস্থার জন্য ভাগ্যকে দোষ দেয়না সে বরং মনে করে সব দোষ ওর নিজের। ওর মতে, বড়ভাই রাজনের বিয়েটাই সব অঘটনের মূল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পূর্বে ঘটা করে বিয়ে হয় বড়ভাইর। ঘটনাচক্রে ক্লাসমেট রেবার বড়বোন জেবাই হন বড়ভাবী। সুতরাং আত্মীয়তার সূত্রে রেবার সাথে  ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। ক্রমে তা পরিনত হয় গভীর প্রণয়ে। সম্পর্কটা এতদিন গোপন থাকলেও কুষ্টিয়ায় বেড়াতে গিয়েই ঘটে যত অঘটন! সেবার বড়ভাই ছুটিতে বাড়ীতে আসেন। বড়ভাবীকে একমাসের জন্য কর্মস্থলে নিয়ে যাবেন। দুপুরে খাবার টেবিলে সুযোগ বুঝে সুজনও বায়না ধরে, ভাবীর সাথে আমিও যাবো, বড়ভাই?
ঃ সে কীরে, তোর না বিএ পরীক্ষা সামনে?
ঃ মাত্র সাতদিন পরই চলে আসবো তো? পরীক্ষার এখনো চারমাস বাকী
ঃ ঠিক আছে, গেলে যাবি- অগত্যা ছোটভাইর দাবী মানতেই হয় রাজনকে।

আবদার মঞ্জুর হওয়ায় খুশীতে বাগ বাগ সুজন ছুটে যায় রেবার কাছে। দু’পরিবারের মধ্যে দুরম্নত্ব মাত্র দুশো গজ। সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা, আকাশ পরিষ্কার। আদিগমত্ম বিস্তৃত সুনীল আকাশে ঘরমুখো পাখিদের দলগত স্রোতকে পেঁজা পেঁজা মেঘ বলেই ভ্রম হয়। আনমনে দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করে রেবা। মৃদূমন্দ বাতাসে চারিদিকের গাছ-পালার নাচন ওর বড্ড ভালো লাগে। এ-ই রেবা, একটা মজার খবর আছে--সুজনের আকস্মিক কন্ঠে চমকে ওঠে সে।
ঃ মজার খবর মানে? কিছু বুঝতে না পেরে পাল্টা  প্রশ্ন করে।
ঃ ভাবীর সাথে আমিও কুষ্টিয়ায় যাচ্ছি। চলোনা দু’জনে বেড়িয়ে আসি--------
ঃ পরীক্ষার সময় বোধ’য় যেতে দেবে না-- রেবা জবাব দেয়।
ঃ তোমার যাবার ইচ্ছে নেই, তা-ই বলো--সুজনের কন্ঠে অভিমানের সুর।
ঃ আচ্ছা, আচ্ছা যাবো। দুলাভাইকে রাজী করিয়ে আমিও যাবো, হলো তো?

রাতে রেবাও এসে বোন-দুলাভাইর কাছে আবদার জানায়। পরীক্ষা নিকটবর্তী হওয়ায় মাত্র দশদিনের জন্য মঞ্জুর হয় দু’জনের দাবী। ফলে ওদের মনে বয়ে যায় উচ্ছ্বল আনন্দের বন্যা। কেননা ওদের প্রণয়ের বিষয়টি এখনো পারিবারিকভাবে জানাজানি হয়নি। সুতরাং কুষ্টিয়া যাবার পরিকল্পনার ব্যাপারে ভাই-ভাবীর মনে সন্দেহের অবকাশ থাকেনা। কিন্তু কুষ্টিয়ায় গিয়েই ঘটে বিপত্তি। রাজন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলেও জেবার চোখে কিচ্ছু এড়ায় না।  অবিবাহিত দু’জন নর-নারীর দম্পতিসুলভ বেপরোয়া আচরণ একজন বিবাহিতা মহিলার চোখকে ফাঁকি দেয়ইবা কী করে? সুতরাং ওদের সম্পর্কের পথে বাধ সাধেন তিনি। দু’জনকে একরকম নজরবন্দি করে ফেলেন। প্রথম প্রথম বোন-দেবরকে পরোক্ষভাবে শাসনও করেন। হয়তো চাঁদনীরাতের বন্যায় ছাদে বসে দু’জন গল্পে বিভোর। জেবা ধমক ছাড়বেন, কীরে দিনরাত তোদের কিসের এত গল্প, বল্ তো? দু’জনে বেরোতে গেছে? ফেরামাত্র সুজনকে একান্তে  ডেকে বলবেন, রেবার সাথে বাইরে এভাবে ঘোরাফেরা করো না, সুজন। অচেনা জায়গায় লোকে বলবে কী ইত্যাদি। সুজন কড়ামেজাজী বড়ভাইর ভয়ে একটু সংযত হয়ে যায়। রেবারও অাঁচ করতে দেরী হয়না। কারণ সুজনের মুখোমুখি হলেই আজকাল রান্নাঘরে ডাক পড়ে ওর--রান্নার কাজেও তো একটু সাহায্য করতে পারিস? একাই মরছি দেখিস না, তা নয় শুধু গল্প! বড়বোনের কথায় রেবার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সপ্তাহখানেকে অবস্থা এমন ঘোরতর হয়ে দাঁড়ায় যে, দু’জনের পারস্পরিক কথাবার্তাও অসহ্য হয়ে ওঠে জেবার। অথচ কিছূ ব্যাপার থাকে যা সহ্য করাও যায় না, মুখ ফুটে বলাও যায় না। তিনিও দু’জনকে সরাসরি কিছু বলতে চাইলেও পারেন না। বিবাহিতা হিসেবে তিনি অবশ্য বিশ্বাস করেন যে, চহহম্বকধমী বিপরীত লিংগের যুবক-যুবতীকে একই ছাউনির নিচে অবাধে চলতে-ফিরতে দিয়ে শাসন করাও নিরর্থক। আসলে সুজন পাত্র হিসেবে মন্দ না হলেও ওদের প্রেম কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না জেবা। কারণ একই পরিবারে আরেক বোনের বিয়ের কথা তিনি কল্পনাও করেন না ।
***
রাজন স্ত্রীর কাছে ভাই-শালিকার ঘটনাবলী নিয়মিত শুনে গেলেও কাউকে কিছু বলতে পারেন না। আদরের ছোটভাইকে মুখ ফুটে শাসন করতে দ্বিধাবোধ করেন। ওসি মানুষ এমনিতে বেশীর ভাগ সময় অপরাধীর সন্ধানে কাটান বাইরে। হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে মাথাঘামানোর সময় তার কোথায়? স্বামীর এই নির্লিপ্ততাকে জেবা কিন্তু অন্যভাবে নেন। এ নিয়ে তাদের মাঝে উওপ্ত বাক-বিতন্ডাও যে হয়না, তা নয়। একসপ্তাহের মাথায় একদুপুরে খেতে এসে কর্মক্লামত্ম রাজন বিছানায় গা এলিয়ে দেন। সুযোগ বুঝে জেবা কথা পাড়েন---কীগো, সুজনকে কিছু বলছো না যে?
ঃ কী বলতে বলো, ওকে?
ঃ বাঃ রে, তা-ও শিখিয়ে দিতে হবে নাকি? জেবার অভিমানী সুর-- ওরা, যে রকম শুরু করেছে, না জানি কখন কী অঘটন ঘটিয়ে বসে?
ঃ দোষতো দু’জনেরই, কাকে কী বলি, বলো---
ঃ কেনো সুজনকে শাসন করলেই তো হয়? ও-ই তো অপকর্মের হোতা--জেবা বোনের পক্ষ নিয়ে দেবরকে অভিযুক্ত করেন।
ঃ দেখো জেবা, একতরফা কথা বলোনা। বিরক্তিপ্রকাশ করেন রাজন, একহাতে কি তালি বাজে, তোমার বোনকেও তো শাসন করতে পারো?
ঃ তা কি করিনি? কেউতো কথা শোনে না--জেবার কন্ঠে হতাশা ও আত্মাভিমানের সুর।
ঃ তা-ই বলো, দোষ আসলে দু’জনেরই আবার বলতে গেলে কারম্নর নয়। অবাধ মেলামেশার সুযোগ দিলে অমনই হয়, আপনমনে একনাগাড়ে বলে যান রাজন।
ঃ তাহলে তুমি বলতে চাও, ওরা আমাদের মুখে চুনকালি দিক! তবু কিছু করবেনা? জেবা ক্ষোভে ফেটে পড়েন ।
ঃ আহ--রাগ করো কেনো, তাই বললাম নাকি?
ঃ তবে কী? কাপুরম্নষ কোথাকার, নিজের ভাইকে শাসন করতে পারেনা, অথচ আমার বোনকে---জেবা নিজেকে সামলাতে পারেন না এবার । ফলে দেবরের ওপর জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটান।
           
জেবার অদভহত ব্যবহারে রাজন ‘থ’ বনে যান। পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্বেও আঘাত হানে স্ত্রীর বিদ্রুপবাণ। তাই কথা না বাড়িয়ে বিছানা থেকে নি:শব্দে নেমে রাগে গড় গড় করে দ্রুত চলে যান থানায়। সন্ধ্যার পর হঠাৎ বাসায় ফেরেন। এ সময় সাধারণত তিনি ফেরেন না। বাসার সবাই তাই চমকে ওঠে। হাসি-খুশী বড়ভাইর গম্ভীরমুখ দেখে রেবার মতো সুজনও ভড়কে যায়। ফলে অজানা আশংকায় নিজের রম্নমে গিয়ে ঢোকে। কিন্তু দূর্ভাগ্য, রাজন সরাসরি ওরই রুমে ঢুকে পড়েন। এ-ই হারামজাদা, কী শুনছি এসব। ফাজলামো পেয়েছিস, না? ঘাড় মটকে দেবো একদম, কালই তুই চলে যাবি এখান থেকে---একটানা গালাগাল করে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যান ফের। সুজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে বড়ভাইর অস্বাভাবিক কান্ডে! এ ঘটনার পর রাতেই অভিমানে আত্মহত্যা করতে গিয়েও ব্যর্থ হয় সে। পরদিনই সে চলে আসে লালমনিরহাটে।

ঃ এ-ই সুজন ভাত খাবি আয়, অনেক রাত হয়েছে----আম্মার ডাকে দীর্ঘ ভাবনায় ছেদ পড়ে যায়। ক্ষিদে  নেই তবুও নাকে-মুখে কিছু গুঁজে দিয়ে আবার পড়ার টেবিলে এসে বসে। ফের ভাবনাগুলো ওকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরে। আজ দু’তিনবছর থেকে দু’পরিবার সম্পর্কহীন। ওদের কারণে দু’পরিবারের কেউ কারো ছায়া মাড়ায় না। বড়ভাই-ভাবীও আর সুজনদের বাড়ীতে যাতায়াত করেন না। রেবার সাথে কোন যোগাযোগ পর্যন্ত নেই সুজনের। অবশ্য এরমধ্যে কড়া নিরাপত্তায় রেবা ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেনি। আরো দু’বার চেষ্টা করেও পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি বিয়ের চেষ্টাও কম হয়নি। সুজনই সকল সম্বন্ধ ভেঙ্গে দিয়েছে। তবে রেবাকে ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার হুমকি দেয়ার পর থেকে সুজনের পড়াশোনাও যেমন ভেসেত্ম যায় তেমনি রেবাও হয় ঘরবন্দী। কিডন্যাপের হুমকি দেয়ায় সুজনের পড়াশোনার খরচপাতি বন্ধ করে দেন বড়ভাই। আর্থিক অবস্থা অস্বচ্ছল বলে বড়ভাই-ই ওর পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। ফলে দীর্ঘদিন পর ওর বিএ পাশের সাধ জাগলেও সে সুযোগ আর নেই। তাছাড়া লালমনিরহাটের বিষময় পরিবেশেও সে হাঁফিয়ে উঠেছে। ওর  পক্ষে এখানে ডিগ্রী পাশ করাও অসম্ভব। অথচ তিন-চারটে বছর পাগলামী করে কত না হাসম্পদ হয়েছে সে? আববার সার্বক্ষণিক বকাঝঁকা, বাপের হোটেলে খাস্ তো, হুঁশ পাস্ না? বড়ভাইর চোখরাঙানী- রাখো ওই বদমাশের পড়াশোনা, টাকা-পয়সা কিচছু দেবো না আর। সে কিনা আবার গলায় দঁড়ি দিয়েও মরতে বসেছিল! বড়ভাবী না দেখলে নির্ঘাত পটল তুলতেই হতো। এসব ন্যাকামোপনার কথা ভাবলে এখন দারম্নন হাসি পায় ওর। ছি: ছি: আমি একটা কাপুরম্নষ-অপদার্থ, নিজেকে ধিক্কার দেয় সে। হ্যাঁ-এ বন্দীশালায় আর থাকা নয়। নারকীয় পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতেই হবে। অতএব ভেবে-চিমেত্ম ঢাকা যাবার সিদ্ধামত্মই পাকাপোক্ত করে ফেলে।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গে সুজনের। ঢাকা যাবার সিদ্ধামেত্ম আজ মনটা হালকা মনে হয়। থানাপাড়ার রাসত্মায় অনেক্ষণ হাঁটে। ওর ইচ্ছে করে, এুক্ষনি ঢাকায় ছুটে যায়। কিন্তু অর্থসংকটের কথা ভেবে হোঁচট খায়। সূর্য ওঠার এখনো আধঘন্টা বাকী? কর্মচঞ্চল পাখিরা নীড় ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে কর্মসংস্থানে। সবুজ প্রকৃতি আজ ওর কাছে নতুনত্ব নিয়ে ধরা দেয়। একটা টুনটুনি মেহেদী গাছে নাচানাচি করছে। দাঁড়কাকগুলো কা-কা রবে উড়ে যাচ্ছে দূরে। একটা কাঠঠোঁকড়া ঠক্ ঠক্-- কাঠ কেটে চলেছে। কেউ কোথাও বসে নেই, সবাই কাজে ব্যসত্ম। এসব দেখে ওর মনে হয়, আশেপাশের গাছ-গাছড়াগুলো আর সে-ই বুঝি এ জগতের একমাত্র কর্মহীন-বেকার। আসলে কি তাই? বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এ-ও জানে, সূর্যের আলোয় গাছের পাতারা সালোক-সংশেস্নষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরী করে উদ্ভিদকে বাঁচায়। সুতরাং কে বেকার ও কর্মহীন? সে ছাড়া বোধ’য় আর দ্বিতীয় কেউ নেই। কী সুজন কেমন আছো---হঠাৎ পরিচিত কন্ঠে চমক ভাঙ্গে ওর। জবাব না দিয়ে চেয়ে দেখে রেবার বড়ভাই মতি চেয়ারম্যান পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। প্রাক্তন চেয়ারম্যান মতিভাই একসময় ওকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু এখন ঘৃণাই শুধু করেন না, এ লোকটাই ওকে বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। কুষ্টিয়ার ঘটনার পর একসন্ধ্যায় তার সাথে রাসত্মায় সুজনের দেখা। মতিভাই, আসসালামু আলাইকুম---সুজন স্বভাবসূলভভাবে সালাম ঠোকে। কিন্তু তিনি জবাব না দিয়ে বরং ঝাঁঝের সাথে বলেন, সুজন দাঁড়াও।
ঃ কিছু বলবেন মতিভাই? তার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেলেও স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করে। ঃ
 ন্যাকা, যেন কিছুই বোঝেনা, হঠাৎ অশোভন বিদ্রম্নপবানে সুজনের বেহাল অবস্থা। শোনো, তোমাকে ছোটভাইর মতোই দেখতাম। কিন্তু তুমি এত বাজে ছেলে, তা জানতাম না। তোমার কী যোগ্যতা আছে যে, আমার বোনের পেছনে ঘুরঘুর করো। এটা সিনেমার জগৎ নয়, বুঝলে? একটানা বলেই প্রত্যুত্তরের সুযোগ না দিয়ে রিক্সায় উঠে পড়েন তিনি। আজ দীর্ঘদিন পর দেখা। কিন্তু তার কুশল জিজ্ঞাসার জবাবে, কী বলবে সে? ভালো আছি, তাতো বলা যায় না! আবার ভালো নেই--এও কি বলার অপেক্ষা রাখে? তাই সে তার কথার উত্তর না দিয়ে কৃত্রিম মুড দেখিয়ে হন্-হন্ করে বাসার দিকে হাঁটা দেয়।

মতিভাইকে দেখার পর অবশ্য ঢাকায় যাবার উদগ্র বাসনাটা আরও প্রবল হয়। ঢাকায় গিয়ে এবার যেকোন মূল্যে ডিগ্রী পরীক্ষা দেবেই। পাশের পর চাকরীজীবি সুপাত্র হিসেবে মুখোমুখি দাঁড়াবে মতিভাইর! সপ্তাহখানেকের মধ্যে সে সত্যি সত্যি ঢাকায় চলে যায়। ওঠে একটা মেসে। যাবার আগে বড়ভাই-ভাবীসহ পরিবারের সবার মন জয় করেই তবে যায়। বিশেষত: রাজন ওর পরিবর্তনে ভীষন খুশী। বিদায়ের সময় তাই বলেন, তুই যদি আর পাগলামী না করিস এবং ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করিস, তোর সব খরচ দেবো আমি। ঢাকার একটা প্রকাশনীতে পার্টটাইম চাকরি জুটিয়ে নেয় সুজন। প্রাইভেটে ডিগ্রী পরীক্ষারও প্রস্ত্ততি নিতে শুরম্ন করে। ওর ঢাকাগমণের কারণে রেবাদের পরিবারও স্বসিত্মর নি:স্বাস ফেলে। অতএব একে মোক্ষম সুযোগ ভেবে তারাও শুরম্ন করে দেন রেবার বিয়ের তোড়জোড়।  একমাসের মধ্যে ওর বিয়ে দেয়া চাই-ই।
***
দুপুরবেলা বড়ভাইর মানি অর্ডার পায় সুজন। তিনমাসের মধ্যে এটা দ্বিতীয় মানিঅর্ডার। সাথে ছোট একটা চিরকুট। মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। মানিঅর্ডারের চিরকুটটাও পড়তে ভুলে যায়। এ সময় কেনো যেনো রেবার স্মৃতিই মনে হানা দিতে থাকে। তাই সে বিছানায় শুয়ে মধুরস্মৃতি রোমন্থনে নেমে পড়ে। এসময় রেবার চিঠিগুলোও হাতছানি দেয় ওকে। স্বর্গীয় আনন্দে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে ছোট্টবাক্সে সংরক্ষিত একগাদা চিঠি পড়তে লেগে যায়। দুপুরের খাবারের কথা আর খেয়াল থাকে না। চিঠিগুলো গোগ্রাসে গিলতে থাকে। একটা চিঠিতে এসে চোখ স্থির হয় ওর। কয়টা লাইন সে বারবার আওড়াতে থাকে এবং রোমাঞ্চিত হয়। ‘‘প্রিয় নাগর আমার, রেবাকে হারাবার এত ভয় কেনো, বলোতো? দু’জনই যেদিন পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে শপথ করেছি, সেদিনই তো আমি তোমার হয়ে গেছি গো?-----বোকা ছেলে, পাগলামো করো না। বরং ভালো করে লেখাপড়া চালিয়ে যাও। আমাদের সম্পর্ক কেউ ভাঙতে পারবে না। ইতি- তোমার হবু বউ।’’ চিঠি পড়ে মনের প্রচ্ছন্ন হতাশাটা দূর হয় ওর। প্রবল একটা আত্মবিশ্বাসও জাগে। হ্যাঁ, রেবা যেখানেই থাক্ না কেনো ওকে ভুলবেনা, ভুলতেই পারেনা। ফলে উৎফুল্ল মনে পানাহারপর্ব সেরে ফের বিছানায়  শুয়ে পড়ে সে।

পরদিন শরতের রঙিন বিকেল। আকাশে খন্ড খন্ড মেঘের ভেলা এবং পাখিদের আনাগোনা প্রেমিক মনে জোয়ার তোলে। সদ্য ঘুমজাগ্রত সুজনের ফুরফুরে হৃদয়েও শত শত স্মৃতি আর রেবাকে পাবার উগ্র বাসনার ভেলাগুলো নিরমত্মর ঢেউ তোলে। তাই পোশাক পরেই দ্রুত চলে যায় চাকরিতে। মেসে ফেরে রাত ১১টায় এবং রুমের লাইট জ্বালিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে। শরীর ক্লান্ত কিছুটা। হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা বড়ভাইর চিরকুট নজরে পড়তেই সাগ্রহে হাতে তুলে নেয়। ‘‘সুজন, টাকা পাঠালাম, প্রয়োজন মত খরচ করিস। আরও দরকার হলে লিখবি। আর শোন্- ছয়মাসের আগে লালমনিরহাটে আসার চিমত্মাও করবি না। পড়াশোনার ধান্ধায় থাকবি। অন্যথায় টাকা পাঠানো সম্ভব হবে না। রাজন।’’ চিঠি পড়ে মনের আনন্দ মিলিয়ে যায় মূহুর্তে। এভাবে চিঠি লিখলেন কেনো? সহসা ভাবনার ইলাস্টিকটা দিগমত্মপ্রসারী হয়। অজানা আতংকে আবোল-তাবোল চিন্তার জট বাড়তে থাকে। এ যে দেখছি বাড়ীতে পদার্পণের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা! অমান্য করলে নাকি টাকাও পাঠাবে না? মেজাজ বিগড়ে যায় ওর। তাই চিরকুট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে না খেয়েই সটান শুয়ে পড়ে বিছানায়। খুব ভোরে দু:স্বপ্নে ঘুম ভাংগে ওর। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে। রেবার বিয়ে? হ্যাঁ--রেবার বিয়ে হয়ে গেছে! স্বপ্ন নয় যেন সত্যি ঘটনা। চিরকুট আর স্বপ্নের মধ্যে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র আছে! ইচ্ছে করে এক্ষুনি ছুটে যায় বাড়ীতে। এ সময় দরজায় কড়ানাড়ার শব্দে ঘোর কাটে ওর।  হেঁকে ওঠে--কে?
ঃ আমি দীপু দোস্ত, দরজা খোল্--। প্রিয়বন্ধুর গলা শুনে ভুলে যায় এতক্ষণের রুদ্ধশ্বাস টেনশন। এলোমেলো মনটা আবার ভালো হয়ে যায়।
ঃ দোস্ত, লালমনিরহাটের খবর কী বল্, দরজা খুলে দিয়েই সোজা ছুড়ে দেয় প্রশ্নটা।
 ঃ কোন্ খবর নিবি? রেবার খবর জানিস তো---?
ঃ রেবার খবর মানে? অত্যুগ্রহে জিজ্ঞেস করে সুজন, খারাপ কিছু নয়তো?
ঃ চিড়িয়া ভাগ গিয়া বুঝলি, ভাগ গিয়া----
ঃ কী--যা-তা বলছিস, মেয়ে মানুষ হয়ে সে ভাগবে কেন? হেঁয়ালী ছাড়্ তো দীপু?
ঃ হেঁয়ালী মানে--তুই কিছু জানিস নে! বিস্মিত হয় দীপু।
ঃ কী জানবো, কী হয়েছে আগে বল্ না, অনাহুত টেনশনে সুজনের নি:শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম।
ঃ ধন্য প্রেমিক, তুইরে। দু’মাস হলো রেবার বিয়ে হবার, আর তুই কিনা---কথা শেষ করতে পারে না দীপু। ‘বিয়ে’ শব্দটা কানে যেতেই, কী বললি---বলেই বিকট চিৎকার দিয়ে যেনো বাকরম্নদ্ধ হয় সুজন। পরমূহুর্তে দু’হাতের দশ আংগুলে মাথার চুলগুলো এমনভাবে খামচে ধরে যেন টেনে ছিঁড়েই ফেলবে। অতপর টেবিলের ওপর রাখা চিঠিগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে ছিঁড়ে শত খন্ড-বিখন্ড করে দু’হাতে ছিঁটিয়ে দেয় মাথার ওপর!!