22.5.11

শিশু অধিকারঃ বুকের দুধ বনাম গুঁড়োদুধ

সালেহার তিনবছর বয়সী কন্যা ময়না সারাবছরই ডায়েরিয়া, বদহজম, কলেরাসহ নানারকম রোগে ভুগতে ভুগতে বর্তমানে কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে মৃতপ্রায় যেন। বাল্যবিবাহের শিকার চরম অভাবী সংসারের এ কিশোরীমাতাটি পুষ্টিহীনতায় নিজেই যেখানে হারিয়েছে শরীরের স্বাভাবিকতা, সেখানে একবছরের ব্যবধানে পরপর জন্ম দিয়েছে অপুষ্ট দুটো নিষ্পাপশিশুর। চারবছর বয়সী বড়ছেলেটি জন্মের পর কয়েকমাস পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধপানের সুযোগ পেলেও ময়নার ভাগ্যে জোটেনি একফোঁটা দুধও। রোগে-শোকে অসুস্থ সালেহার পুষ্টিহীনতার কারণে জন্মের পর ময়না পায়নি বুকের দুধ। ওকে তাই ৪/৫ মাস পর্যন্ত একটানা খাওয়াতে হয়েছে ভাতের মাড়, গরুর দুধ ইত্যাদি কৃত্রিম শিশুখাদ্য। এরপর এইযে শুরু হলো বাছবিচারহীন খাওয়া-দাওয়া, আজও চলছে সে-ই ধারা। একনাগাড়ে ৬মাস পর্যন্ত বুকের দুধ পানতো দুরের কথা, হাবিজাবি খেয়েই তাকে এপর্যন্ত আসতে হয়েছে। ফলে যা হবার তা-ই হয়েছে। মাতৃদুগ্ধ পানের সুযোগ না পাওয়া শিশুটির ওপর নেমে এসেছে প্রকৃতির খড়গ। স্বাভাবিকভাবেই তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে, ফলে হয়ে গেছে চিররোগা। 

অন্যদিকে তাকালে আমরা কী দেখি, এদেশে আবহমানকাল থেকে দু‘আড়াইবছর পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রথা ও এতিহ্য চলে এলেও নারী স্বাধীনতার ধুম্রজালে পড়ে কিছু কিছু মা তার শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পানের ক্ষেত্রে চরম অনীহা প্রদর্শন এবং আপত্তি করে থাকেন। তাদের অজুহাত হচ্ছে- বুকের দুধ খাওয়ালে মাতৃস্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ ফ্যাশন হিসেবেও বুকের দুধের বদলে বাজারের প্যাকেটজাত শিশুখাদ্য খাইয়ে শিশু প্রতিপালনে আগ্রহী। কিন্তু এর ফলে প্রাণাধিক শিশুর যে কী মর্মান্তিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, তা তারা বুঝতেই পারেন না। 

অথচ কৃত্রিমদুধ সম্পর্কে ২২জানুয়ারি/০৭ তারিখে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর প্রকাশিত গবেষণাধর্মী সরেজমিন রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে এক ভয়াবহ তথ্য। আর তা হচ্ছে- বাজারে প্রচলিত ও বহুলবিক্রিত প্যাকেটজাত দুধের ৮০.৬৬ ভাগ এবং পাস্তুরিত তরলদুধের ১০০ভাগই হচ্ছে ভেজালযুক্ত-নিম্নমানের। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে আরও বলা হয় যে, সাধারণ শিশু ও বৃদ্ধরা দেহগঠন ও ক্ষয়পূরণের উদ্দেশ্যেই দুধপান করে থাকে। কিন্তু বাজার থেকে কেনা এসব দুধের মাধ্যমে সে উদ্দেশ্য পূরণতো হচ্ছেই না বরং ক্রেতারা রীতিমত প্রতারিত হবার সাথে সাথে শারীরিক ও আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্যাব ঢাকা মহানগরীর বাজার থেকে ১৫টি ব্রান্ডের গুঁড়োদুধ এবং ৩টি ব্রান্ডের পাস্তুরিত তরলদুধের নমুনা সংগ্রহ করে বিসিএসআইআর এর ‘ইনস্টিটিউট অব ফুড সাইন্স এন্ড টেকনোলজিতে’ পরীক্ষার জন্য প্রেরন করে। 

বিসিএসআইআর কর্তৃপক্ষ গুঁড়োদুধ ও তরল দুধের জন্য প্রণীত স্বীকৃত বিডিএস স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর/০৬ পর্যন্ত) তিন মাসব্যাপী পরীক্ষান্তে উক্ত পরীক্ষণ রিপোর্টটি ক্যাবকে সরবরাহ করে। পরীক্ষাগারে প্রেরীত ১৫টি গুঁড়োদুধ ছিলো- প্রাণ, ডিপ্লোমা, মিল্কভিটা, নিডো, স্টারশিপ, এ্যাংকর, রেডকাউ, ফ্রেশ, ড্যানিশ, কোয়ালিটি, মার্কস, ফার্মল্যান্ড, এ্যানলিন, দাসমিল ও প্রোলিন এবং তিনটি পাস্তুরিত তরলদুধ হচ্ছে- মিল্কভিটা, আড়ংদুধ ও আফতাব। 

পক্ষান্তরে সদ্য ভূমিষ্ঠ একটি ক্ষুদে মানবশিশুর প্রথম ও মৌলিক মানবাধিকারই হচ্ছে, নিশ্চিন্তে-নির্বিঘ্নে বুকের দুধ পানের অধিকার। প্রায় দেড় হাজার বছর পুর্বে পবিত্র কুরআনেও আল্লাহ তাআলা এব্যাপারে বিজ্ঞানসম্মত নির্দেশ জারী করে বলেছেন-‘‘মায়েরা তাদের সন্তানদের দু‘বছর পর্যন্ত বুকের দুধ পান করাবে (সুরা:নিসা)।’’ এখানে যেমন শিশুর দু‘বছর পর্যন্ত বুকের দুধের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, তেমনি এসময় আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের মাধ্যমে ঘনঘন সন্তানধারণকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দু‘বছরের মাঝখানে আরেকটি শিশু জন্মদানের দ্বারা প্রথম শিশুটির দুধপানের অধিকার ক্ষন্নে না করার সাথেসাথে ঘনঘন সন্তানধারনের মাধ্যমে মাতৃস্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ না করারও মেসেজ দিয়েছেন আল্লাহতাআলা। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদেও মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা ও ভূমিকার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এভাবেই-‘সমাজের সবাই বিশেষত: মা-বাবারা যাতে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য ও শিক্ষা পেতে পারেন, রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে।’ তবে আশার কথা যে, সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘ কর্তৃক বুকের দুধের পক্ষে ব্যাপক ক্যাম্পেইন চালানোর ফলে মাতৃদুগ্ধ পানের প্রবণতা দিনদিন যেমন বাড়ছে, তেমনি কৃত্রিম শিশুখাদ্য খাওয়ানোর হারও ধীরেধীরে কমছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বুকের না খাওয়ানোর কারণে প্রতিবছর ১৫লাখ শিশুর অকালমৃত্যু ঘটে থাকে। এছাড়া মাতৃদুগ্ধ বঞ্চিত আরও লাখলাখ শিশু উদরাময়, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, কানের প্রদাহসহ নানারকম এলার্জির শিকার হচ্ছে। বিশেষত: শিশুজন্মের পরপরই হলুদ বর্ণের শালদুধই হচ্ছে সদ্যজাত শিশুর জন্য একটি আদর্শ এন্টিবায়োটিক, যার মাধ্যমে উপরোক্ত রোগগুলো থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আরেক তথ্যানুযায়ী, কৃত্রিম দুধপানকারী একজন শিশুর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাবার ঝুঁকি, স্তন্যপানকারী শিশুর চেয়ে পাঁচগুণ বেশি; বুকের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে যাবার সম্ভাবনা দ্বিগুণ; এমনকি মূত্রথলি ও কিডনির সংক্রমণে আক্রান্ত হবার আশংকাও পাঁচগুণ বেশি। পরিবারে এলার্জির ইতিহাস থাকলে একজিমা ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হবার আশংকা দ্বিগুণ; দাঁতের রোগে ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিও অত্যধিক। আর এ শিশুটির অপরিণত জন্ম হয়ে থাকলে, মারাত্মক আন্ত্রিক প্রদাহে আক্রান্ত হবার আশংকা স্তন্যপানকারী শিশুর চেয়ে বিশগুণ বেশি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন কর্তৃক বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের এক অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে ‘আমদানি করা গুঁড়োদুধ খেলে শিশুদের রোগে আক্রান্ত হবার আশংকা ২০গুণ বেশি থাকে। পাশাপাশি মাতৃদুগ্ধধ পান করানোর মাধ্যমে প্রতিবছর লাখলাখ শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব।’ এমনকি স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শিশুকে বুকের দুধ পান করালে মায়ের স্তন-ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা যেমন কমে যায়, তেমনি নিয়মিত স্তন্যদানকারিনীদের স্বাভাবিক গর্ভসঞ্চারও এসময় বিলম্বিত হয়ে থাকে। 

ক্যাব নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেছেন যে, দুধসহ সকল পণ্যের মানযাচাইয়ের দায়িত্ব বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত থাকলেও তাদের শিথিলতার কারণেই শিশুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব গঁড়োদুধ অবাধেই বিপনণ করা হচ্ছে। এসব দুধের মোড়কে বা কৌটায় অনেক সময় মেয়াদের উল্লেখ থাকেনা। ফলে ব্যবসায়ীরাও মেয়াদোত্তীর্ণ দুধ বিনষ্ট না করে পুনরায় মোড়কে পুরে বা কৌটায় ভরে বিক্রি করছে। শুধু এদেশেই নয়, পৃথিবীর বহুদেশেই শিশুখাদ্য বিপনণের ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাই বুকের দুধপানকে উৎসাহিতকরণ ও শিশুখাদ্য বিপণনকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একসভায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি ও এনজিওরা অংশ নেয়। সেখানে সম্মিলিতভাবে বুকের দুধের পরিবর্তে কৃত্রিম শিশুখাদ্যের বাণিজ্যিক প্রসার বন্ধ করার জন্য একটি বিপণন কোডের রূপরেখা তেরি করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার এক ভোটাভুটির মাধ্যমে ১১৮টি দেশের সমর্থনে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্টমিল্ক সাবস্টিটিউট’ গৃহীত হয়। আন্তর্জাতিক কোডটির উদ্দেশ্য হলো- শিশুর স্তন্যপানের অধিকাররক্ষা, সুন্দর ও মহান এ চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটানো এবং কোডের নির্দেশনানুযায়ী দুগ্ধের পরিবর্তগুলোর যথাযথ বিপণন নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিশুদের নিরাপদ খাদ্য ও পর্যাপ্ত পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করা। কোড অনুযায়ী জনসাধারণ্যে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবেনা, মা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নমুনা বা উপহার হিসেবে এসব পণ্য দেয়া নিষিদ্ধ। এসব পণ্যের মোড়কে মাতৃদুগ্ধপানের পক্ষের তথ্যাবলী সন্নিবেশন ও বোতলজাত দুধপানের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করতে হবে। আর কোনোক্রমেই লেবেলে যেমন শিশুর ছবি ব্যবহার করা যাবেনা তেমনি শিশুখাদ্য প্রসারের জন্য কোনো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও ব্যবহার করা যাবেনা। এসব পণ্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করা এবং শিশুদের মায়েদের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ ও বিক্রির ক্ষেত্রে তাদের কোনোরকম সুবিধা প্রদান করাও নিষিদ্ধ। মোড়কে ও লেবেলে বুকের দুধ পানের বিপক্ষে বাবা-মাকে নিরুৎসাহমূলক কোনো তথ্য দেয়া যাবেনা। মোড়কে ও লেবেলে ইনফ্যান্ট ফর্মুলার শুদ্ধ ব্যবহারবিধি উল্লেখ করতে হবে ও ভূল ব্যবহারের ঝুঁকি সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য দিতে হবে। এসব পণ্য সম্পর্কে প্রদত্ত তথ্য বিজ্ঞানসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। শিশুখাদ্য শুধুমাত্র গবেষণা কাজের নমুনা হিসেবে অনুমোদিত বা ব্যবহার করা যাবে। 

উল্লেখ্য যে, এ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি দেশ কোডগুলো বাস্তবায়নে পরিপূর্ণ অথবা আংশিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোডগুলোর বেশির ভাগকেই ইতোমধ্যে আইনে পরিণত করেছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে বর্তমানে নিম্নমানের শিশুখাদ্য সরবরাহকারী ও বিএসটিআই এর মানদন্ড লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি আমদানি ও বিপণনক্ষেত্রে নীতিমালা লংঘনের বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নেয়াটা এখন সময়ের দাবীমাত্র।